নির্মাণ পিডি নিয়োগে অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রস্তাবনার অভিযোগ

3

মনিরুল ইসলাম মুন্না

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগের প্রস্তাবনায় পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল গফুরের নাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) প্রস্তাবনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আওয়ামী লীগের দোসর এমনকি চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে পার্বত্য কোটা ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে অন্যান্য কর্মকর্তাদের মাঝে।
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য যোগদানকৃত উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘কোন প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে আমরা কাউকে দায়িত্ব দিতে পারি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ব্যাপার। আমরা তালিকা পাঠিয়েছি। উনারা যাচাই বাছাই করে নিয়োগ প্রদান করবেন। বর্তমানে অস্থায়ী পিডি হিসেবে উনি (আবদুল গফুর) আছেন, পূর্ণাঙ্গ পিডি আসলে উনি আর থাকবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য সবার সাথে বসেছি। সেখানে আমি বলেছি, কেউ যদি অনিয়ম দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকতে চান, তাহলে স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারেন। অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছি।’
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূইঁয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় এখনও কাউকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেয়নি। নিয়োগ কমিটির আমিও একজন সদস্য। আবদুল গফুরকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দেখতে বলা হয়েছে। এখানে কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের নেতৃত্বে যে কমিটি রয়েছে সেখানে আমার পাশাপাশি প্ল্যানিং কমিশন, যাচাই-বাছাই কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন), অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা), ফিন্যান্সসহ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। উনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলো আমি জেনেছি। কমিটির সকল মেম্বারদের সাথে আলোচনা করে পিডি নিয়োগ করা হবে। আমি তো একা অনুমোদন দিতে পারি না। তবে পরবর্তী পিডি না আসা পর্যন্ত উনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন।’
এদিকে গত ২২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত একটি প্রস্তাবনা পত্রে আবদুল গফুরসহ তিন জনের নাম প্রস্তাব করা হয়। বাকি দুইজন হলেন উপ রেজিস্ট্রার (সংস্থাপন-১) অনিল জীবন চাকমা এবং উপ রেজিস্ট্রার (প্রশাসন শাখা) মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তবে অনিল জীবন চাকমা এবং মোহাম্মদ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলেও আবদুল গফুরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি কয়েকটি দপ্তরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক এবং পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক আবদুল গফুর অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে চাকরি নেন। চাকরিতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী দাবি করে ২০১৬ সালের ২৬ জুনে প্রকাশিত চাকরির এক বিজ্ঞপ্তির অনুকূলে এ পদে যোগদান করেন। ২০তম গ্রেডের অফিস সহায়ক পদে আবেদন করতেও যেখানে উল্লেখ থাকে, শিক্ষা জীবনে তৃতীয় বিভাগ কিংবা ২.৫০ এর নিচে রেজাল্ট গ্রহণযোগ্য নয়, সেখানে শিক্ষা জীবনে দুটি তৃতীয় বিভাগে পাশ করেও তিনিই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালকের মত পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
আবদুল গফুরের শিক্ষাগত যোগ্যতায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে তিনি কুমিল্লা বোর্ড থেকে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন, ১৯৯২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে কুমিল্লা বোর্ড থেকে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন, ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৃতীয় বিভাগ নিয়ে বাণিজ্য বিভাগে বি.কম ডিগ্রি লাভ করেন, ১৯৯৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে ব্যবস্থাপনায় এম.কম এবং সর্বশেষ ২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগ থেকে এল.এল.বি পাশ করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, বাণিজ্য বিভাগ হতে পাশ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের দায়িত্ব কীভাবে পালন করেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। অথচ তখন চাকরির শর্তে উল্লেখ করা ছিল- ‘ক. প্রার্থীকে কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে যেকোন বিষয়ে ন্যূনপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির/সমমান গ্রেডের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী অথবা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) পাশ হতে হবে। খ. বিশ্ববিদ্যালয়/সরকারি/আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে পাঁচ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং গ. বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) ডিগ্রিধারী ও অভিজ্ঞ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে।’
পূর্বে সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও তিনি ২০১৭ সালে সরাসরি রাবিপ্রবির সহকারী পরিচালক হয়ে যান। পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন একটি প্রকল্পের হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি করে নিজেকে পূর্বেও সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বলে দাবি করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নীতিমালার ঠিক কতটা পূরণ হয়েছে তা অজানা হলেও আবদুল গফুর সহকারী পরিচালক পদে ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে নিয়োগ পেয়েছেন।
পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাসীন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক হওয়া এবং পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হওয়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আওয়ামী সমর্থিত সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. সেলিনা আক্তারকে ব্যবহার করে তিনি পদোন্নতিসহ নানা অপকর্ম করে গেছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন টেন্ডারে তিনি আধিপত্য বিস্তার করতেন। এছাড়া আবদুল গফুর রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার কমিটির আহŸায়ক, ক্যাম্পাস প্ল্যান রিভিউ কমিটির আহব্বায়ক। দরপত্র ছাড়া ও সরকারের রাজস্ব দেওয়া ছাড়া ভিসি, প্রো-ভিসি, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর না থাকলেও কোনো প্রকার টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই ৬ লক্ষ ২৮০ টাকার ক্রয় করেন তিনি। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে তিনি নিজেকে বিএনপি নেতা দাবি করে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আবদুল গফুর আওয়ামী লীগের একজন দোসর। এমনকি তিনি সাবেক এমপি দীপঙ্কর তালুকদারের সাথে সখ্যতা রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল প্রদানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবিই তার যথাযথ প্রমাণ। আওয়ামী ঘরানার উপাচার্যের সাথে আঁতাত করে সব অপকর্ম করে বেড়াতেন। পদোন্নতির সময়ও উপাচার্যকে তিনি ব্যবহার করেছেন। সরকার পরিবর্তনের পর নব্য বিএনপি বলে দাবি করলেও তো তিনি মূলত একজন ফ্যাসিবাদের দোসর। তাকে প্রকল্প পরিচালক না দিয়ে যোগ্য একজনকে সে পদে দেয়া আমাদের একমাত্র দাবি।’
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক এবং পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল গফুর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি জামায়াত বানিয়ে আমাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। অফিসার সমিতির নির্বাচনে ভিসি আমাকে ফেল করাইছে। বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে ভিসির দ্ব›দ্ব ছিল। আমাকে ভিসি প্রমোশন পর্যন্ত দেননি। তিনি তার স্বামী প্রফেসর রুহুল আমিনের কথামত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউছুপ নামে একজনকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়ে আসেন। কামরুল হাসান ও সেতু চাকমাকে বিনা পরীক্ষায় চাকরি দেন। ছাত্রলীগের ক্যাডার রাকিব, মহিম আল মহিউদ্দিন, যুবলীগ ক্যাডার শাহেদ সরওয়ারসহ কয়েকজনের সাথে আমার দ্ব›দ্ব। তারাই আমার নামে বিভিন্ন অভিযোগ দিচ্ছে। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা তখন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিথিল করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে যে কর্মরত ছিলাম, সেটাই সরকারি জিওভি খাতের অন্তর্ভূক্ত থাকায়, সরকারি চাকরি হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।’
সাবেক এমপির সাথে সখ্যতা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো গত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্টদের কার্যক্রমে এবং চাকরির স্বার্থে বাধ্য হয়ে অংশগ্রহণ করেছি। তখন আমরা নিরুপায় ছিলাম। আমার যা বলার আদালতে বলবো ইনশাআল্লাহ।’
রবিপ্রবি’র সাবেক উপাচার্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রফেসর ড. সেলিনা আক্তারকে এসব বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।