নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কেন প্রয়োজন

2

জসিম উদ্দিন মনছুরি

গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারের গুরুত্ব অত্যাধিক। দেশের জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দমত প্রার্থী বাছাই করে সরকার গঠনে সহায়তা করে। প্রতিটি ভোটারের চাওয়া থাকে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী বিজয়ী হোক। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বারোটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলমান পদ্ধতির নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটারের গুরুত্ব থাকে না। কেবল বিজয়ী ভোটারের মূল্যায়ন থাকে। যদিও ১০০% ভোটের মধ্যে বিজয়ী ভোটের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪০ পার্সেন্ট এর বেশি হয় না। আবার ধরা যাক ৩০০ আসনের মধ্যে প্রতিটি আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী একভোটে পরাজিত হলো। তাহলে বিজয়ী দলের ভোটের ব্যবধান মাত্র ৩০০ টি। ৩০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ায় তাদের সংসদে কোন প্রতিনিধি থাকবে না। যদি ধরা হয় বিজয়ী প্রার্থী ৪০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তাহলে ৬০% ভোটারের ভোটের কোন গুরুত্বই থাকে না।চলমান সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারকে অনেকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেহেতু চলমান পদ্ধতিতে অধিকাংশ ভোটারের ভোট কাজে আসে না। ধরা যাক ১০০ জন ভোটারের মধ্যে ৩৩ পার্সেন্ট ভোট পেয়ে কোন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।
প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী পেয়েছেন ৩০% ভোট। তাহলেই তিনি ৩০% ভোট পেয়েও পরাজিত হয়েছেন। তার মানে ৩০% ভোটারের কোন গুরুত্বই থাকলো না। চলমান পদ্ধতিতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলি পাঁচ কিংবা সাত পারসেন্ট ভোট পেলেও তাদের সংসদে কোন প্রতিনিধিত্ব থাকেনা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে চলমান পদ্ধতির নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ জনগণের ভোটের গুরুত্ব থাকেনা। যদি তেত্রিশ পার্সেন্ট ভোট পেয়ে জয়ী হন কোন প্রার্থী তাহলে এক তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েও তিনি সংসদ সদস্য হতে পারেন। অবশিষ্ট ৬৭ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্ব থাকেনা সংসদে। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে প্রতিটি ভোটারের সমান গুরুত্ব বিরাজমান। ধরা যাক ১০০ এর মধ্যে ৩৩% ভোটারের রায় নিয়ে জয়ী দল পাবেন ৩৩ টি আসন। পক্ষান্তরে ৩০% ভোট পেয়ে পরাজিত প্রার্থী পাবেন ৩০ টি আসন। এভাবে প্রতিটি ভোটারের সমান গুরুত্ব থাকে পিআর পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনা কোন দলই। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় না এবং দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস পায়। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দেশের চলমান প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে পাঁচটি কমিশন গঠন করে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সংস্কারের প্রধান দাবি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সঠিক পদ্ধতি। আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে কেবল ভোটারের দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রার্থীরা ভোট ভিক্ষা করে থাকে। ভোটের সময় পেরিয়ে গেলে নির্বাচিত হয়ে জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি দল স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়। ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে শুরু হয় ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং সীমাহীন অর্থপাচার। জবাবদিহিতা তেমন একটা না থাকায় সরকারি দল নির্ভয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। চলমান পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলি ২০% ভোট পেয়েও নির্বাচিত হয় না। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের বিশাল একটি ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে যারা ক্ষমতার স্বাদ বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকায় বিশাল জনগোষ্ঠী অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপিসহ পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ঐক্যমত পোষণ করলেও দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বরাবরই বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভয় হচ্ছে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে কোন দলেরই এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। আবার কোন দল এককভাবে ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকেনা। ধরা যাক দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা প্রায় ১০%। চলমান পদ্ধতির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংখ্যালঘুর ব্যানারে আজীবন চেষ্টা করলেও তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কিন্তু যদি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হয় তাহলে ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ৩০ টি আসল লাভ করবে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে না। পিআর পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্যও সফল একটি পদ্ধতি বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হলে ভোটারের গুরুত্ব যেমন থাকবে তেমনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রতিটি দলের প্রার্থী থাকবে। তাহলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ভেদাভেদ, রাজনৈতিক দলের মধ্যে দূরত্ব এবং একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ থাকবে না। সরকার হবে জবাবদিহিতার সরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংস্কারের কথা আসায়, সংস্কারের অন্যতম প্রধান দাবি চলমান নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার।তা যদি হয় পিআর পদ্ধতি তাহলে নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। এই পদ্ধতির নির্বাচন হলে স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান এর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা পাবে। স্থানীয় নির্বাচন পদ্ধতি শক্তিশালী হবে। জনগণ ও সেবা গ্রহীতারা আরো বেশি সেবা পাবে। স্থানীয় নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাব তেমন একটা থাকবে না। জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারবে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে এবং জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে।আশা করি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল পিআর পদ্ধতি মেনে নিবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে রাজনৈতিক দলগুলির শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তাহলে কেবল গণতন্ত্র শক্তিশালী ও সুসংগত হবে। আশা করি এ ব্যাপারে ঐক্যমত কমিশন যথাসময়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনও যথাসময়ে নির্বাচন দিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিবে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক