বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বাস্তবে রূপ দিতে আগামী নির্বাচন ঘিরে ইসলামপন্থি দলগুলোর ঐক্যের সুর শোনা গেল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে। নিজেদের মধ্যে ঐক্য ‘প্রতিষ্ঠা’ হয়েছে দাবি করে আগামী জাতীয় নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে করার সম্ভাবনার কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলের নেতারা। সংস্কার, বিচার ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ হয়, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সমালোচনাও হয়েছে। খবর বিডিনিউজের
সমাবেশের মূল পর্ব শুরু হয় দুপুর ২টায়। তার আগে থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশস্থলে। এদিন সকাল ১০টায় কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাবেশের প্রথম পর্ব। তাতে বক্তব্য দেন সারাদেশ থেকে আসা জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতারা। দুপুর ২টায় মহাসমাবেশের মূলপর্ব শুরু হওয়ার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় ভরে যায়। মহাসমাবশে সভাপতির বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। মহাসমাবশে সভাপতির বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। সকাল থেকে শাহবাগ, মৎস্যভবন, প্রেস ক্লাব, দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার এলাকায় সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা বাসে করে এসে জড়ো হয়। দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের সবগুলো ফটকে দীর্ঘ জটলা দেখা যায়। উদ্যানে প্রবেশ করতে না পেরে মৎস্য ভবন মোড়ে এলইডি পর্দায় সমাবেশ দেখছেন কয়েকশ নেতাকর্মী।
সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলনের বাংলাদেশের আমির (চরমোনাই পীর) সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, গণ-আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। আমি শুরু থেকেই ইসলামপন্থি সকল ভোট এক বাক্সে আনার কথা বলছি। আগামী নির্বাচনে শুধু ইসলামী দলই নয়, বরং অনেক দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দল ‘এক বাক্স’ নীতিতে আসতে পারে। যদি কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে পারি, তবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরাই হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই আসবে। তিনি বলেন, সংস্কার না করে নির্বাচন আয়োজন করে দেশকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সংসদের উভয় কক্ষের পিআর পদ্ধতিতে ঐকমত্য না হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন আমির বলেন, আমরা রাষ্ট্রে সুশাসন চাই। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাই। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানও জনতার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আমরা ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা দক্ষ ও সৎ জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে চাই। তিনি বলেন, আমরা নিঃস্বার্থভাবে এই সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছি। সংস্কার, বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে অঙ্গীকার নিয়ে আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকুন। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লক্ষ থেকে বিচ্যুত হবেন না। নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করুন। আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকবো।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আজকের দিন এক ঐতিহাসিক দিন। মুসলিম উম্মার নেতৃত্বদানকারী সকল ইসলামী দল, ব্যক্তিত্ব ও স্কলারদের মধ্যে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও আজকে ঐতিহাসিক যে ঐক্যের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, মঞ্চে যারা বসে আছেন তারাই এই ঐক্যের মহাকান্ডারী। ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি বলেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ, কারো প্রতি পক্ষপাত করবেন না। জাতির স্বার্থে নিরপেক্ষ থাকবেন। দুই হাজার ছাত্র জনতার জীবন হাজার হাজার মানুষের রক্ত, ফাঁসি, ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না।
গোলাম পরওয়ার বলেন, ড. ইউনুসকে বলতে চাই আপনার কোন কোন ভুমিকায় জাতির মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। পরিষ্কার বলতে চাই, আপনি সোজা থাকবেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে দিতে হবে। ১ থেকে ৮ আগস্ট এর মধ্যেই জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করতে হবে। আপনাকে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। আপনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে এক কথা বলবেন আবার একটি দলের সাথে বৈঠকে আরেক কথা বলবেন এতে আপনার নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। একটি নির্দিষ্ট দলের সাথে আলোচনা করে মত বদলানো ভালো লক্ষণ নয়। মহাসমাবেশ থেকে ১৬ দফা দাবি ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। দলের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন।
দলটি ১৬ দফা দাবি হল- ১, সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রূপে পুনঃস্থাপন। ২. সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। ৩. জুলাই সনদের ঘোষণা ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে জাতীয় ঐকমত্য। ৪. ভবিষ্যৎ স্বৈরাচার ও দলীয় কর্তৃত্ববাদ রোধে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার। ৫. সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে ‘ফ্যাসিবাদী’ প্রভাবমুক্ত সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। ৬. পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার ও পালাতক অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার ক‚টনৈতিক পদক্ষেপ। ৭. পাচার করা অর্থ উদ্ধার ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ। ৮. সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও খুনখারাবি রোধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা। ৯. ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি প্রকাশ ও দেশবিরোধী চুক্তির বাতিল। ১০. জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন ও তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন। ১১. দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। ১২. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করা। ১৩. ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। ১৪. ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কর্মকান্ডে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। ১৫. জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজদের প্রতিহত করা। ১৬. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামের আলোকিত আদর্শ বাস্তবায়নের আহবান।
সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের দলীয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্য রাখেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মূসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দীন মহাসচিব, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউসুফ সাদিক হক্কানী, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু।