পূর্বদেশ ডেস্ক
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত হলেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, এমন বিধান রেখে আইন করার প্রস্তাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে একমত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি রাষ্ট্র সংস্কারকে আইনিভাবে বৈধতা দেওয়ার জন্য গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া তত্ত¡বধায়ক সরকার গঠন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয়, জনপ্রশাসনের জন্য স্থায়ী কমিশনের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াত।
গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে জামায়াতের সংলাপ শেষে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াতের ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসেন সকাল ১০ টায়। সন্ধ্যায় ৬ টায় সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন জামায়াতের নেতারা। খবর বিডিনিউজের
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনে হত্যার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে আসছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
এই ‘গণহত্যা ও গুমের’ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের সাবেক আইজিসহ কয়েকজন সদস্যের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধে ট্রাইব্যুনালে।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর অন্যতম নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতরা যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে সেজন্য একটি বিশেষ আইন করার প্রস্তাব করেছে।
সে প্রস্তাব তুলে ধরে জামায়েতের নায়েবে আমির বলেন, ‘সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত হলে নির্বাচনে অযোগ্য হন, এটা আগে থেকেই হয়ে আসছে। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রসিডিউর শুরু হলে, তাদের বিরুদ্ধে যদি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) হয়ে যায়, তখন তারা আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। যদিও মামলা দিলেই একটা লোক অযোগ্য হবেন তা না, দোষী সাব্যস্ত হলে তখন হতে পারেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ তো একটা ভিন্ন ধর্মী অপরাধ, এটা সাধারণ অপরাধ না। সুতরাং একটা বিশেষ সময়কে ভিত্তি করে, এই সমস্ত অপরাধে কারো বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়ে গেলে তারা নির্বাচনে আসতে পারবেন না। আমাদের প্রস্তাব ছিল শাস্তি পাইলে অযোগ্য ঘোষণা করা, কিন্তু ওনারা যেহেতু যুক্তি দিয়েছেন যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সাধারণ অপরাধের মত না। সাধারণ অপরাধ হলে দুই বছরের জন্য শাস্তি পেলে অযোগ্য হবেন’।
তাহের বলেন, ‘আমরা পরে এটা মেনে নিয়েছি। একটি বিশেষ অপরাধে একটি বিশেষ সময়ে যে অপরাধ হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেটার জন্য দুই বছরের সাজার শর্ত প্রযোজ্য হবে না। যদি বিচারপ্রক্রিয়ায় চার্জশিট হয়ে যায়, তখন নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হবে’।
জামায়াতে ইসলামী সংস্কারকে আইনগতভাবে বৈধ করার জন্য গণভোট দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, আমরা গণভোট চাই, গণভোটের মাধ্যমে আমাদের জুলাই সনদ হোক, জাতীয় সনদ হোক এর বাইরেও যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে সেটাকে যুক্ত করে জামায়াতে ইসলামী গণভোট চায়। গণভোটের মাধ্যমে চ‚ড়ান্ত হবে। গণভোট হচ্ছে সকল মানুষের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা। গণভোট আইনগত সিদ্ধ হবে, সামাজিক প্রভাব আছে, রাজনৈতিক প্রভাব আছে, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রভাব আছে। সুতরাং জামায়াত আইনগত ভিত্তির জন্য গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে’।
গণভোট কি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে, না আগে চেয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘আমরা আবারও বসবো, তখন আলোচনায় বলতে পারবো’।
এছাড়া তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে নিজেদের দেওয়া প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে আমরা দুইটা প্রস্তাব দিয়েছি। একটা হচ্ছে সব শেষ বিদায় নেওয়া প্রধান বিচারপতি উনি হবে। আর একটা প্রস্তাব হল- তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের জন্য একটা সার্চ কমিটি হবে, সেই সার্চ কমিটি কীভাবে গঠন হবে সেই প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন তিনি, বিরোধী দলের প্রধান যিনি সংসদে থাকবেন এবং দায়িত্বে থাকা প্রধান বিচারপতি-এই তিনজন মিলে সার্চ কমিটি হবে। এই সার্চ কমিটির তিনজন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করবেন’।
‘ঐকমত্য হলেই জাতীয় সনদ’
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, দ্রæততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে একটি জাতীয় সনদের দিকে অগ্রসর হতে চায় কমিশন। জামায়াতের সঙ্গে কমিশনের সংলাপের শুরুতে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা দু-একদিনের মধ্যে শেষ করে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করবে কমিশন৷ প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল বিষয়ে মতভিন্নতা থাকবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সে সকল বিষয়ে ঐকমত্যের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারবো’।
অনেক রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘যাদের আত্মদানে এই সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের দায় আছে। এ দায় শুধুমাত্র জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নয়। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি, সুশীল সমাজ ও সামাজিক শক্তিশালীগুলোরও এ দায় রয়েছে’।
সংলাপে কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর অন্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ, এহসান মাহবুব যোবায়ের, সাইফুল আলম খান মিলন, মতিউর রহমান আকন্দ, নুরুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, শিশির মোহাম্মদ মনির ও সরকার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।