দিন যতই যাচ্ছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঢালপালা ততই বিস্তার করছে। সরকারের ঘোষণা অবস্থানগত দৃঢ়তা ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির মহাযজ্ঞে আগামী ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে দেশবাসী বেশ আশাবাদী হলেও জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপির মত রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কেন্দ্রিক বিভিন্ন বক্তব্য এবং বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের ঘটনা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে আদৌ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এরমধ্যে নির্বাচন নিয়ে জাতীয ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটে গেছে। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা জাতি সংঘের মাধ্যমে দেশে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামীলীগসহ সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা গতকাল বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। এনসিপি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার আলোকে ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। এদিকে নির্বাসনের ১৭ মাস পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনসহ তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তাতে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নানা সৃষ্ট শঙ্কা আরো বেশি জোরদার হতে যাচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। নির্বাচন হলেও কার অধিনে হবে? বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধিনে হবে, নাকি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধিনে হবে- এনিয়েও চলছে নানারকম মুখরোচক আলোচনা। কয়দিন আগে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সরকার প্রধানের সাথে দেখা করে প্রত্যেকে অন্তত তিনজন করে উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া বিএনপি স্পষ্টভাবে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত¡াবধায়কের ভ‚মিকা নিতে হবে। কোনরকম পক্ষপাত হওয়া চলবে না। বিএনপির এমন বক্তব্যের সাথে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ একমত না হওয়ার কারণ নেই। এমনকি উপদেষ্টাদের অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ভূমিকায় দেখতে চান বলে আমাদের ধারণা। এ ধারণা জন্মেছে সম্প্রতি তথ্য ও স¤প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি গত ২৬ অক্টোবর রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভা নভেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে মাহফুজ আলমের বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। সরকারের প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারের গৃহীত সংস্কার ও নীতিমালা প্রণয়নের কাজ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে, এটা সঠিক নয়, বরং সংস্কার কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে চলমান থাকবে। এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাবে এবং উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকও নিয়মিত হবে। সরকারের এই বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, মাহফুজ আলমের এ বক্তব্যে সরকার যেন নাখোশ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা যা হওয়া উচিৎ, মাহফুজ আলমের বক্তব্যে সেটাই উঠে এসেছে। নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী সরকারই থাকবে। এ সরকার নির্বাচিত কোনো সরকার নয়। তার প্রধানতম দায়িত্ব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যা যা করার দরকার তা করে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। নিয়মিত সরকারের মতো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে দায়িত্ব পালন করা নয়। তারপরও এ সরকার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এসব সিদ্ধান্ত নেয়া সঠিক হয়নি বলে বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের যে দায়িত্ব, তার ব্যত্যয় ঘটেছে এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় ও নির্বাচন দেয়া নিয়ে অনীহা প্রবণতাকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো ভালোভাবে নেয়নি। সংগত কারণেই তারা দ্রুত নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রাখে। তবে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা এবং একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল ছায়া সরকারে পরিণত হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা উপভোগ করার কারণে নির্বাচন নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু হয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়ায় সরকারের পক্ষে দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেও তার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে নির্বাচনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে হয়ত, তার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষমতাকে আরও পাঁচ-দশ বছর প্রলম্বিত করত। যেহেতু নির্বাচন ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ নেই, তাই তার ফোকাস এখন নির্বাচনের দিকে। এ প্রেক্ষিতে, নির্বাচনকালীন সরকারের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র ঠিক করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রযন্ত্র থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কমান্ডে চলে। সরকারের কাজ শুধু রুটিন কাজ করা। নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়া তার দায়িত্ব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এ উপলব্ধি আশা জরুরি যে, কোনভাবেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করা যাবে না। এ সরকারকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারে পরিণত হতে হবে। এ ব্যত্যয় ঘটলে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমাদের মনে হয়না।











