নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি কাজ ফেরত গেছে দুইশ কোটি টাকা

0

এম এ হোসাইন

চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজে নির্ধারিত সময় বাড়িয়েও পুরো কাজ শেষ করা যায়নি। ফলে প্রকল্প থেকে প্রায় দুইশ কোটি টাকা ফেরত গেছে। দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয় বৃদ্ধি, কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন এবং অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেই প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। প্রকল্পের বারবার সময় বাড়ানো হলেও সব কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। শেষ পর্যন্ত কিছু আইটেম বাদ পড়ায় ফেরত দিতে হয়েছে বিপুল অর্থ। অর্থ ফেরত যাওয়ার বিষয়টি প্রকল্পের ‘ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা’ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রকল্পে কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ৮২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করেছে এক হাজার ১৫০ কোটি ৬৫ লাখ এবং ওয়াসা নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়েছে ২০ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুল বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ। প্রকল্প থেকে প্রায় দুইশ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। কাজ কম হয়েছে এমন না, কিছু কাজ করতে হয়নি আবার কিছু কাজের কাটছাট হয়েছে। প্রকল্পে তো একটি আইটেম না। সবকিছু মিলিয়ে এই টাকাটা ফেরত গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঠিকাদার কাজ তদারকি করবেন। এখন টেকনিক্যাল বিষয়গুলো তারা দেখছেন। এদিকে রাজস্ব খাত থেকে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা আছেন। ফেব্রæয়ারির আগে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে লোকবল পাব। না হলে এদিক-ওদিক করে কাজ চালিয়ে নিতে হবে।’
ওয়াসা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন পাওয়া ভাÐালজুড়ি প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে নির্ধারিত ছিল এক হাজার ৩৬ কোটি টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ভ‚মি জটিলতায় শুরুতেই তিন বছর আটকে যায় কাজ। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন পায় এবং ব্যয় বাড়তে বাড়তে দাঁড়ায় এক হাজার ৯৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকায়। অর্থাৎ প্রাথমিক ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ৯৫৯ কোটি টাকা বেশি।
কাজের সময়সীমাও একাধিকবার বাড়ানো হয়, প্রথমে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত, পরে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু তবুও পুরো কাজ শেষ হয়নি। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সময় ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ঘাটতির প্রমাণ মিলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকায় ৪১ দশমিক ২৬ একর জমিতে নির্মিত ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ছয় লাখ ঘনমিটার পানি সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে বোয়ালখালী, কর্ণফুলী ও পটিয়া উপজেলা এবং কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, সিইউএফএল ও কাফকো শিল্প এলাকায় পানি সরবরাহের কথা রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পানি শোধনাগারের পাশাপাশি পাইপলাইন, পাম্পিং স্টেশনসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তবে শুরু থেকেই প্রকল্পটি অভিযোগের মুখে ছিল। ভ‚মি অধিগ্রহণে অনিয়ম, ঠিকাদার নিয়োগে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং কাজের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণাধীন বেশ কিছু অংশে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। পাইপলাইন বসানোর সময় সঠিক গভীরতা ও মান বজায় না রাখার ঘটনাও আলোচনায় আসে। বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ উঠে এলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কোনো বড় তদন্ত ছাড়াই কাজ এগিয়ে নেয়। দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয় বৃদ্ধি ও মান নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটি শেষ হলেও সময়মতো জনসেবা নিশ্চিত হয়নি। এখনো পুরো সক্ষমতায় পানি সরবরাহ শুরু হয়নি, যা প্রকল্পের দক্ষতা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং টেকনিক্যাল পরিকল্পনার সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পটি অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। শহরে পানির চাহিদা অর্ধেকও পূরণ করতে পারছে না। সেখানে গ্রামে প্রকল্প নিতে হলো। প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিয়মে ভরা। এখন সেখানে গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না। ওয়াসার জন্য এটি বড় বোঝায় পরিণত হয়েছে।’
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা, একাধিকবার সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি এবং শেষ পর্যন্ত বিপুল অর্থ ফেরত যাওয়া প্রকল্পটির ব্যর্থতা ফুটে উঠে। তাছাড়া ওয়াসার প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এখনই প্রকল্পটির কার্যকারিতা মূল্যায়ন, অনিয়ম তদন্ত এবং পরিচালন কাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মনে করছেন অনেকে। না হলে ভবিষ্যত প্রকল্পগুলো একই পরিণতি হতে পারে।