নিরাপদ সড়ক সেই বহুদূর!

2

গতকাল ২২ অক্টোবর বুধবার দেশব্যাপী পালিত হয়েছে নিরাপদ সড়ক দিবস। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর স্বনামধন্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সস্ত্রীক কক্সবাজার যাওয়ার পথে চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় স্ত্রী জোহরা কাঞ্চন। ছোট্ট দুই সন্তানের মা জোহরাকে হারিয়ে তরুণ এ অভিনেতা ঠিক সিনেমার মতই প্রতিবাদি হয়ে উঠলেন এবং একঝাঁক তরুণকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন। এ আন্দোলন হয়ত বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও বাস্তবে সড়কগুলো কাক্সিক্ষত নিরাপদ হয়ে উঠেনি। বরং দেখা গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য যতবেশি সড়ক নির্মাণ বা প্রশস্ত হচ্ছে, তত বেশি দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল যখন দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে তখন ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পঁচিশ বছর ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনায় দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক ব্যাপক আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে নিয়ে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করেন। সেই বছর থেকে দেশব্যাপী ২২ অক্টোবর ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’পালন করা হয়। শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে এবং এই আন্দোলনের ফলে দ্রুততম সময়ে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হয়। নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সড়ক আইন মেনে চলার গুরুত্ব বোঝানো। বাস্তবে নিরাপদ সড়ক এর কিছুই এখন দৃশ্যমান নয়। নিরাপদ সড়ক আইন করা হয়েছে, সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন বাংলাদেশ সরকারি সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে একটি বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এখনও প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনা হচ্ছে, মৃত্যুর মিছিলও অব্যাহত আছে। আন্দোলনের পর গত ৭ বছরে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তা দেখলে গা শিউরে ওঠে। ২০২৪ সালে- বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬,৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮,৫৪৩ জন নিহত এবং ১২,৬০৮ জন আহত হন। ২০২৩ সালে- একই সংস্থার তথ্যে, ৬,২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৯০২ জন নিহত এবং ১০,৩৭২ জন আহত হয়েছিলেন। ২০২২ সালে- রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে ৬,৮২৯টি দুর্ঘটনায় ৭,৭১৩ জন নিহত এবং ১২,৬১৫ জন আহত হন। ২০১৯ সালে- সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জাতীয় সংসদকে জানান, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দশ বছরে ২৫,৫২৬ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে কিছু পার্থক্য দেখা যায়, যা তথ্য সংগ্রহের ভিন্ন পদ্ধতির কারণে হতে পারে। তবে, সব প্রতিবেদনে হতাহতের সংখ্যা ব্যাপক বলে উঠে এসেছে এবং এটি একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের সড়ককে নিরাপদ করতে হলে চালক, পথচারী, যানবাহন এবং রাস্তার পরিবেশ- এই চারটি ক্ষেত্রেই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’। সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় দুটি কারণের একটি মোটর সাইকেলের নিয়ম না মানা আর যেকোন গাড়ির অতিরিক্ত গতি। আমরা মনে করি, প্রতিপাদ্য বিষয়টি সময়োপযোগী তবে এটিকে কার্যকর করতে হলে সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ দুটিই প্রয়োজন। বিশেষ করে. চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আরও কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, এবং মোবাইল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা- ক্লান্তি বা অন্য কোনো মানসিক অস্থিরতা থাকলে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারিদেরও সচেতনতা জরুরি। রাস্তা পার হওয়ার সময় জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করা, কানে হেডফোন বা মোবাইলে কথা না বলা উচিত। রাস্তা পরিচ্ছন্ন রাখা- রাস্তায় কোনো আবর্জনা, ফলের খোসা বা অন্যান্য ময়লা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা জেনেছি, সরকার সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি যাত্রীবাহী যানবাহন, পথচারী, চালক এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সুরক্ষার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেবে। তবে এ আইনে যেন শুভাঙ্করের ফাঁকি দেয়ার মত ব্যবস্থা রাখা না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আমরা মনে করি, সড়ক নিরাপত্তা নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে সড়ক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অপরিহার্য। এক্ষেত্রে সরকার আরো বেশি আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।