দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি। নানা ধরনের বিধিনিষেধ সত্তে¡ও এসব গাড়ি চলাচল রোধ করা সম্ভব হয়নি। বরং সব ধরনের নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে এসব ফিটনেসহীন গাড়ি চট্টগ্রাম মহানগরসহ দেশের সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ মাঝেমধ্যে এসব যানবাহন জব্দ করে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই পুরোনো অবস্থা আবার দৃশ্যমান হতে থাকে। গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ সোমবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা এবং জেলা এলাকার গণপরিবহন রুটে ফিটনিসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। দেখা যায়, এসব গাড়ি সড়কে চলতে চলতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এগাড়িগুলোর অধিকাংশই ভাঙা বডি, লাইট না জ্বলা, টেক্স টোকেন ফেইল। এমনকি রোড পারমিটও থাকেনা। অথচ সড়ক পরিবহন আইন ও বিআরটিএ’র বিধি অনুযায়ী এসব গাড়ি সড়কে নামার কোন সুযেগই নেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের চাপে ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না, উল্টো বেড়েই চলেছে। বিগত সরকারের আমলে এসব গাড়ি প্রায় খবরের শিরোনাম হতো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব গাড়ি চলাচল বন্ধে জোরালো পদক্ষেপের গ্রহণের কথা বলতেন, কিন্তু দৃশ্যত এর কোন লক্ষণ কখনো দেখা যায় নি। শুধু মাঝেমধ্যে অভিযান হতো, কিছু গাড়ি আটকানো হতো। এরপর যে লাউ সেই কদু। আমরা মনে করি, বর্তমান সরকার যেহেতু রাজনৈতিক নয়, সেহেতু এখানে প্রভাবশালী বলতে যা বুঝায় তা এখন নেই বললেই চলে। এসময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক থেকে সরাতে না পারলে, ভবিষ্যতে আর সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে, সড়ককে নিরাপদ করতে হলে এসব যানবাহনের দ্রæত এর লাগাম টানা উচিত বলে আমরা মনে করি। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের অর্ধশত বৈঠকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত ও পুরোনো গাড়ি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দফায় দফায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। এরমধ্যে ২০১৭ সালে গণপরিবহনে সুষ্ঠু যাত্রীসেবা নিশ্চিতে যে ২৬ দফা সুপারিশ তৈরি করা হয়, তার অন্যতম ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে তার সামান্যই। দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯। কারো কারো মতে, এ সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে। অন্যদিকে যানবাহনের সংখ্যা অনুযায়ী বিআরটিএতে ফিটনেস দেখভালে পাঁচ শতাধিক মোটরযান পরিদর্শক থাকার কথা থাকলেও এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
বিআরটিএতে নিবন্ধিত ২০ ধরনের গাড়ির মধ্যে রাজধানীতে চলাচল করছে পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাস। এসব যানবাহনের ৮৮ শতাংশের ফিটনেস নেই। মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৪ অনুসারে, মোটরসাইকেল ছাড়া বাস-মিনিবাস বা প্রাইভেট কারের মতো গাড়ির বছরে একবার ফিটনেস পরীক্ষা করাতে হয় বিআরটিএ কার্যালয়ে। গাড়ির নির্মাণকালীন নকশা অক্ষত থাকা, ব্রেক-গিয়ার ঠিক থাকা, দরকারি বাতি থাকা, কালো ধোঁয়া বের না হওয়া, রং ঠিক থাকা গাড়িকে চলাচলের উপযোগী বলা হয়। ফিটনেস পেতে অন্তত ৩৬ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয় পরীক্ষা করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এই ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা খালি চোখেই এসব পরীক্ষা করছেন।
২০২০ সাল থেকে সরকার নতুন করে সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি ও জরিমানা বাড়ায়। আইনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা বা উভয় দে র বিধান রাখা হয়। এর বাইরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধসহ নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার জন্য গত আট বছরে ২৪০টি সুপারিশ করেছে বিভিন্ন কমিটি। দুদকও ২১টি সুপারিশ দিয়েছে। ২০১৮ সালে প্রণিত সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি ও জরিমানা বাড়ানো এবং পরে আইনের বিধিমালা করা হলেও মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের অভাবে থামানো যাচ্ছে না ফিটনেসবিহীন যানবাহন। প্রকৃতপক্ষে এসব গাড়ি নিরাপদ সড়কের অন্যতম অন্তরায়। জীবন ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এসব গাড়ি। সুতরাং যতদ্রæত সম্ভব এসব গাড়ি সড়কে চলাচলের যে বিধিবিধান আছে তা কার্যকর করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিটনেস ও সড়কের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করবে আর এটাই আমাদের প্রত্যাশা।