নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি পথে প্রতিদিনই বিকল হচ্ছে ট্রেনের ইঞ্জিন। যে কারণে ‘নিরাপদ বাহন’ ট্রেনে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। ইঞ্জিন বিকলের কারণে টর্চলাইট জ্বালিয়ে, অন্য স্টেশন থেকে পুনরায় ইঞ্জিন সংযোজন করে গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হচ্ছে। এমনকি ট্রেনযাত্রাও বাতিল করা হয়েছে। অনেক সময় স্টেশন এলাকায় ইঞ্জিন বিকল হলে বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যে ফিরলেও দুর্গম রেলপথে ইঞ্জিন বিকলে বিপদের মুখে পড়েন যাত্রীরা। যতক্ষণ আরেকটি ইঞ্জিন সংযোজন হয়নি ততক্ষণই যাত্রীদের বাধ্য হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেনেই কাটাতে হচ্ছে। আর এমন ইঞ্জিন বিকল নিয়মিত হওয়ায় ট্রেনের শিডিউল রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে রেলওয়ে।সদ্য বদলি হওয়া পাহাড়তলী ডিজেল ওয়ার্কশপের ব্যবস্থাপক এতেশাম মো. শরীফ পূর্বদেশকে বলেন, ‘কারখানায় ইঞ্জিন মেরামতের চাপ বেড়েছে। এরপরেও যন্ত্রাংশ যথাসময়ে না পাওয়ায় শিডিউল মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। যেভাবে প্রতিনিয়ত ইঞ্জিন নষ্ট হচ্ছে স্বল্প জনবল নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে’।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ১৫ জুন কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় ঈদগাঁও ইসলামাবাদ স্টেশনে আটকে পড়ে। পরে চট্টগ্রাম থেকে আরেকটি ইঞ্জিন এনে ট্রেনটি পুনরায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওণা হয়। গত ১৯ জুন ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ৩০২২ ইঞ্জিন পথেই বিকল হয়। পরে আখাউড়া থেকে ২৯৩৩ সিরিজের রিলিফ ইঞ্জিন নিয়ে লাকসাম পৌঁছে। সেখান থেকেই ৩০০৮ ইঞ্জিন নিয়ে ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছায়। একই ট্রেনের ইঞ্জিন গত ৮ জুন বিকল হয়। পরে ৩০২২ ইঞ্জিন নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। গত ১৯ জুন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী তুর্ণানিশিথা ট্রেনের ইঞ্জিন ফৌজদারহাট ও কুমিরা স্টেশনের কাছে দুইবার বিকল হয়। পরদিন ৬০৪ কন্টেইনার ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। এ দুটি ট্রেনই নতুন আনা ৩০০০ সিরিয়ালের ইঞ্জিন দিয়ে চলাচল করছিলো। গত ১২ জুন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহানগর গোধুলী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ক্রুটি দেখা দেয়। গত ১১ জুন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়া সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন শায়েস্তাগঞ্জে বিকল হয়। এতে ট্রেনটি আটকে পড়ায় সিলেটের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ চার ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পরে আখাউড়া থেকে রিলিফ ট্রেন গিয়ে ট্রেনটি উদ্ধার করলে ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। গত জানুয়ারি মাসেও শমসেরনগরে ট্রেনটির ইঞ্জিন বিকল হয়। গত রবিবারে কক্সবাজার স্টেশন থেকে ছাড়ার প্রাক্কালে বিকল হয় সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন। গত ১৭ মার্চ ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিন বিকল হলে ভৈরব স্টেশনের পর আটকা যায়। পরে অন্য ট্রেনের ইঞ্জিন দিয়ে উল্টোপথে ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনে ফেরত নেয়া হয়। একইদিনে চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটি দূর্বল ইঞ্জিন নিয়ে বেকায়দায় পড়ে। এই ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনের এক কিলোমিটার দূরে মেঘনা সেতুতে উঠতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ে। কয়েকদফা প্রচেষ্টায় ইঞ্জিনটি চালু হয়। গত ২১ জুন রাতে ঢাকা থেকে আখাউড়া যাওয়ার পথে তালশহর স্টেশন পার হওয়ার পর হঠাৎ তিতাস কমিউটার ট্রেনের ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয়। ট্রেনটির হেডলাইট সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। পরে টর্চলাইটের আলোয় গতি কমিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার ট্রেনটি চালিয়ে নেয় চালক। গত ৩০ মে সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুকুন্দপুর স্টেশনে পৌঁছালে ট্রেনের ইঞ্জিনের হেডলাইট নষ্ট হয়। পরে টর্চ লাইট জ¦ালিয়ে আখাউড়ার আজমপুর স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার ট্রেনটি চালিয়ে নেয়া হয়। গত ২৮ এপ্রিল ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয় কিশোরগঞ্জে। প্রায় এক ঘন্টা পর ইঞ্জিন সচল করে ট্রেনটি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে।
জানা যায়, প্রায়সময় ট্রেন ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় পথেই যাত্রীদের নষ্ট হচ্ছে কর্মঘন্টা। ইঞ্জিনের কারণে যথাসময়ে গন্তব্যে ট্রেন পৌঁছাতে না পারায় কিংবা ছাড়তে না পারায় নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় স্টেশন কিংবা সড়কপথের কাছাকাছি ট্রেন ইঞ্জিন বিকল হলে বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যে চলে যায় যাত্রীরা। কিন্তু দুর্গম এলাকায় ইঞ্জিন বিকলের কারণে আটকে গেলে পথিমধ্যেই ঘন্টার পর ঘন্টা ভয়ে-আতংকে-শংকায় কাটিয়ে দিতে হয় যাত্রীদের। প্রতিনিয়ত এমন ইঞ্জিন বিকলের ঘটনায় ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে পরিচিত ট্রেনের উপর আস্থা কমছে যাত্রীদের।
এদিকে প্রতিনিয়ত এভাবে ইঞ্জিন বিকলের ঘটনায় ট্রেন চালকরাও বিরক্ত। এভাবে পথিমধ্যে ইঞ্জিন বিকল হলে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় ট্রেন চালকদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুইজন ট্রেন চালক বলেন, ‘ট্রেন নিয়ে স্টেশন ছাড়ার পর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো কিনা প্রতিনিয়ত সেই শঙ্কায় থাকি। নতুন তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিনের চেয়ে পুরানো ইঞ্জিনগুলো অনেক ভালো আছে। তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিন নিয়ে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। ইঞ্জিন মেরামতে জোর দিতে হবে। কি কারণে প্রতিনিয়ত ইঞ্জিনগুলো নষ্ট হচ্ছে তা বের করা উচিত’।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রামের আহব্বায়ক মো. মজিবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল এখন নিত্যদিনের ঘটনা। চালকরা ট্রেন চালাতে গিয়ে ইঞ্জিন বিকলের মতো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার পর যে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে সে নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি চললেও তা নিরসনে বড়ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অথচ ট্রেন ইঞ্জিন বিকল হলে যাত্রীরা চালককেই দোষারোপ করে। ভালোমানের ইঞ্জিন এনে এই সংকট নিরসন করতে হবে। পাশাপাশি বর্তমান থাকা ইঞ্জিনগুলো মেরামতের পরেও কেন বারবার নষ্ট হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে’।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে রেলের বহরে মোট ইঞ্জিন রয়েছে ২৯৭টি। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন ১৬৭টি ও ব্রডগেজ ইঞ্জিন ১৩০টি। রেলট্র্যাকে যুক্ত হওয়ার পর একটি ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল রয়েছে রেলওয়েতে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা ১৪৭টি। বাকি ১৫০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী রয়েছে ৫০টি ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী রয়েছে ১৬টি। অবশিষ্ট ৮৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান রেলওয়ের বহরে থাকা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৫১ শতাংশের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্রডগেজ ইঞ্জিনে তেমন কোনো সমস্যা নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে মিটারগেজ ইঞ্জিনে। মিটারগেজ ইঞ্জিনের স্বল্পতা রয়েছে। এখন যত ইঞ্জিন আছে, তার বেশিরভাগই পুরানো। মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর ফেইল করার সংখ্যা এখন বেশি। নতুন ৩০০০ সিরিজ ইঞ্জিনেও সমস্যা হচ্ছে বেশি। প্রতিমাসে দুটি করে মিটারগেজ ইঞ্জিন লাইনে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বছর ২৪টি ইঞ্জিন মেরামত করা হবে। নতুন ইঞ্জিন আনতে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। টেন্ডার করে দ্রæত এসব ইঞ্জিন রেল বহরে যুক্ত করা হবে। এরপরেই ইঞ্জিন সংকট কেটে যাবে’।