নিরব বিশ্ব, গাজাবাসীর ফরিয়াদ শুনার কেউ নেই

0

মাহমুদুল হক আনসারী

গাজায় অব্যাহত হামলা চলছে। নিরস্ত্র শিশু, নারী মজলুম মানবজীবনকে পাখির মতো হত্যা করছে ইসরাইল ও তার মিত্র বাহিনি। অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে গাজাকে নিশ্চিন্ন করে ফেলছে। গাজার শিশু নারীর আর্তচিৎকারে আকাশ, বাতাশ কাঁদলেও পৃথিবীর বিবেগ কাঁদছেনা। সারা পৃথিবীর মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, ওআইসি, আরবলিগ বিশ্বের মুসলিম কান্ট্রি নিরব ভূমিকা পালন করছে। একটি পৃথিবীর সামনে স্বাধীন একটি দেশকে ধ্বংস করে ফেলছে, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিন, গাজা দেশটিকে মানবহীন করছে সন্ত্রাসি গুন্ডা বাহিনি স্বশস্ত্র একতরফা যুদ্ধের মাধ্যমে। নিরস্ত্র গাজাবাসির আর্তনাদ শুনবার মতো পৃথিবীতে মনে হয় কেনো বিবেকবান বিশ্বনেতা সমিতি কোনো অর্গনাইজেসন নেই।
সন্ত্রাসবাদী ইসরাইলকে কেউই থামাতে পারছেনা। তাদের সন্ত্রাস হত্যাযজ্ঞ থেকে গাজাবাসিকে কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে না। ধণাড্য মুসলিম বিশ্ব তাকিয়ে শুধু পর্যবেক্ষণ করছে। নিরীহ শান্তিকামী বিশ্বের দুর্বল মানুষগুলো শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করছে। সারা দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের পক্ষে মজলুম মানুষের প্রতিবাদ মিছিল মিটিং হলেও বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ ইসরাইল ও তার মিত্রদের সেই বিষয়ে কোনো কর্নপাত নেই। মজলুমের আহাজারী ফরিয়াদ প্রার্থনা আল্লাহ কবে নাগাদ কবুল করেন, তিনিই ভালো জানেন।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ ও হামলার মধ্যে ফিলিস্তিনিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেষ বার্তা ও বিদায় চিঠি লিখে রাখছেন। তাদের আশঙ্কা, এবার তারা বাঁচবেন না। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকেই গাজাবাসী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, ইসরায়েলের আক্রমণ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় হতাশা ও মৃত্যুভয় নিয়ে লেখা পোস্টের সংখ্যা বেড়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েলের হামলা পুনরায় শুরু হওয়ার পর এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। গাজার এক নারী নূরের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি এলাকায় পাশের ভবনে ইসরায়েলি হামলা হচ্ছে। ভিডিওটির পটভূমিতে এক নারীর কান্না শোনা যায়। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘এবার মনে হচ্ছে আমরা বাঁচবো না…’।
দক্ষিণ গাজার রাফাহ থেকে সাংবাদিক আবদুল্লাহ আলাত্তার শুক্রবার সকালের পোস্টে লিখেছেন, ‘এবার আমরা টিকতে পারবো না বলে মনে হচ্ছে।’ এটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। দেইর আল-বালাহর ফুটবল সাংবাদিক আবুবকর আমেদ লিখেছেন, ‘গাজাবাসী জানে, বিশ্ব তাদের নিরাশ করেছে। তাই তাদের হত্যা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
অনেক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী বিশ্ববাসী ও নেতৃবৃন্দকে গাজাবাসীর পক্ষে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজাবাসী শুধু বোমাবর্ষণই নয়, খাদ্য সংকটেরও শিকার হচ্ছেন। এক ফিলিস্তিনি লিখেছেন, ‘মাথার ওপর বোমা, নিচে ক্ষুধা-গাজা আজ ধুঁকছে। আর কতদিন আমরা এভাবে টিকে থাকবো? বিশ্বকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে!’
ইসরায়েলের যুদ্ধ এখনও তার মিত্রদের সমর্থন ও অর্থায়নে চলছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। গত মার্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসের স্বাভাবিক পর্যালোচনা ছাড়াই ইসরায়েলকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করে। বৃহস্পতিবার স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত ৮.৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি বন্ধের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মাত্র ১৫ সিনেটর (যাদের মধ্যে টিম কেইন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এলিজাবেথ ওয়ারেনও রয়েছেন) সমর্থন করায় প্রস্তাবটি ব্যর্থ হয়।
অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর আগে বিদায় বার্তা ও প্রার্থনা পোস্ট করছেন। গাজার লেখক ও ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ বৃহস্পতিবার রাতে এক্স (টুইটার)-এ লিখেছেন, তার লেখা কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। তার লেখা, ‘প্রথমে উৎসাহী ছিলাম, যা লিখতাম সব শেয়ার করতাম। কিন্তু কী দেখলে বা পড়লে তোমরা জাগ্রত হবে-তা আমি জানি না। আমাদের জন্য নয়, তোমাদের বিবেকের জন্য, যাতে ঘুমোতে গিয়ে তোমাদের বিবেক কাঁদে না।’
৩ এপ্রিল আরেক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘গোটা গণহত্যার মধ্যে এত কাছে থেকে কখনও মৃত্যুকে অনুভব করিনি, যতটা করছি এখন।’
ইউরোপীয় হাসপাতাল ও আল-আকসা হাসপাতালের চিকিৎসক হামজা আলশারিফ লিখেছেন, ‘গাজার সর্বত্র বোমাবর্ষণ তীব্র হচ্ছে, রক্তের ছোঁয়া সবখানে।’ ১৮ মার্চ থেকে তার প্রোফাইলে পিন করা পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমি যদি মারা যাই, আমি শুধু একটি সংখ্যা নই-আমি একা এক গ্রহ, আমার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা ছিল। আমাকে তোমাদের দোয়া থেকে ভুলো না, আমার কথা বলতে থাকো।’
গত মাসে ইসরায়েলের মিসাইলে আল জাজিরার ২৩ বছরের সাংবাদিক হোসাম শাবাত নিহত হন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে প্যালেস্টাইন টুডের সাংবাদিক মোহাম্মদ মানসুরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে, তার স্ত্রি ও ছেলেকে হত্যা করা হয়। হোসামের মৃত্যুর পর তার সহকর্মীরা তার আগে থেকে লেখা একটি বার্তা শেয়ার করেন: ‘আপনি যদি এটি পড়েন, তাহলে আমি ইসরায়েলি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়ে নিহত হয়েছি।’
এই আত্মশ্রদ্ধাঞ্জলি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি কবি ও শিক্ষাবিদ রিফাত আলারীর কথা, যিনি গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। তার ‘যদি আমাকে মরতেই হয়’ কবিতাটি ইসরায়েলের যুদ্ধের মধ্যে প্রতিবাদ ও আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
গাজাবাসিকে বাচাতে না পারলে গোটা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। সামর্থবান রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে তাদের বিবেকের নিকট জবাবদিহি হয়ে মানবজাতিকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক ধর্মীয় সংগঠন, ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান, খতিব, ইমাম, মুফতি, মুহাদ্দিস ঐক্যবদ্ধ ভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে সংহতি প্রকাশ করে আসছে। প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অন্চলে গাজাবাসির জন্য মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সভা, র‌্যালি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখান থেকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে গাজাবাসিকে রক্ষার দাবি করা হচ্ছে। আসুন গাজাবাসির পক্ষে যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ গড়ে তুলি।

লেখক : সংগঠক,গবেষক ও প্রাবন্ধিক