নিয়ন্ত্রণের বাইরে সড়ক দুর্ঘটনা লাশের মিছিল থামান

3

সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেড়েছে মৃত্যুর মিছিল। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে অকালে ঝরছে প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অসংখ্য মানুষ। তবু কোনোভাবে কমানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা। বরং দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে । তার জন্য যেমন নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ, তেমনি নেই সচেতনতা। সড়ক দুর্ঘটনা এখন মনে হয় আমাদের দেশে একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটি দেশের অন্যতম জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই স্যোসাল মিডিয়াসহ সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর খবর। বেপরোয়া বাস-ট্রাকের ধাক্কায় বা চাপায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সোস্যাল মিডিয়াগুলো সচল হয়ে উঠে পটিয়ার একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবরে। বার আউলিয়ার অন্যতম হজরত শাহচাঁন্দ আউলিয়া (রা.) এর মাজার গেইটের সামনের সড়ক পার হতে গিয়ে চোখের পলকে দ্রুত গতির একটি মিনি ট্রাক প্রাণ কেড়ে নিল পটিয়ার একজন প্রবীণ আলেমের। ঘাতক ট্রাকটির দুর্ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে যে কারোরই অন্তর বিধ্বস্ত হবে। বেদনায় ভারাক্রান্ত হবে। মনে হবে এতো দুর্ঘটনা নয়, সরাসরি হত্যাকান্ড। মাজারের এ এলাকায় যেকোন গাড়ি আসলে একটু স্লো করে। রমজানের সকাল সড়কে তেমন গাড়ি নেই। দুর্ঘটনায় নিহত মাওলানা আমিনুল ইসলাম সড়ক পার হয়ে সেলুনে যাচ্ছিলেন। একেবারে সড়কের একপাশেই তিনি হাঁটছিলেন। এরমধ্যে বেপরোয়া ঘাতক ট্রাকটি দ্রুত এসে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে শরীরটা টেনে হেচড়ে অনেকদূর নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মাওলানা আমিনুল ইসলামের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর পুরো চট্টগ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। মানুষ ক্ষোভ ও প্রতিবাদে কিছুক্ষণ সড়কও অবরোধ করে রাখেন। সূত্র জানায়, মাওলানা মুফতি আমিনুল ইসলাম পটিয়া শাহচাঁন্দ আউলিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও এলাকার প্রসিদ্ধ সুফিসাধক আল্লামা মুছা মুজাদ্দেদি (রা.) এর জ্যেষ্ঠ সন্তান। তিনি চন্দনাইশের একটি মাদ্রাসার শিক্ষকতা ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কয়েকবছর আগে অবসরে যান। একজন সুফিবাদী আদর্শের ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু ঘাতক বেপরোয়া ট্রাক তাঁর সুন্দর ও আদর্শবান জীবনটিকে মুহূর্তে থামিয়ে দিল। আশ্চর্য হতে হয়, এতোবড় একটি দুর্ঘটনার পরও ট্রাকের চালক গাড়িটিকে থামাননি, নিথর দেহকে ভেদ করে সেই সড়কে লাশ ফেলে চলে গেল। কী নির্মম ! আমরা সড়ক দুর্ঘটনার নামে এ হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। একইসাথে ঘাতক ট্রাকটি জব্ধ করে চালক ও হেলফারকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
গতকালের পটিয়ার এ ঘটনার ন্যায় প্রতিদিন প্রতিক্ষণে দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। এ সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলনও করেছে। ওই সময় তৎকালীন সরকার ‘নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করলেও এতে গাড়ির চালক-মালিকদের কিছু আসে যায় নি। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি। বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ডিসেম্বরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০২টি। এই ধারা নতুন বছরেও অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম তিন দিনে দুর্ঘটনা ঘটেছে সর্বমোট ১৬টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ সব দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। দেখা যাচ্ছে, তিন দিনের প্রতিদিনে গড়ে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার দুর্ঘটনার হিসাবে প্রতি দুর্ঘটনায় প্রায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর এভাবে কয়েক হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। একই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু-দুই-ই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। এর মধ্যে এমন কিছু দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়, যা মানুষকে অধিক মাত্রায় মর্মাহত ও বেদনার্ত। এমনও দেখা যায়, দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি কিংবা পরিবারের সবারই মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের মৃত্যু মানুষকে হতবিহব্বল এবং গভীর শোকের মধ্যে নিক্ষেপ করে। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের জন্য দায়ী বেপরোয়া চালক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে সড়কে শৃঙ্খলা, যাতায়াতসহজতা ও নিরাপত্তা বেশি নিশ্চিত হতো, দুর্ঘটনাও কমত। এছাড়া সরকার মহাসড়কে ধীরগতির যান যেমন অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা কেউ মানেন না। অথচ এসব যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে এবং কখনো কখনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে এদের চলাচল বন্ধ করা যায়নি। সড়ক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ আছে বটে, কিন্তু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে তেমন দেখা যায় না। সড়ককে সুশৃঙ্খল, বাধামুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। এ ব্যাপারে অনুসরণ করতে হবে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের ছোট-বড় সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন করে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু রোধ করা যাবে না, যদি আইন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা করার প্রবণতা থাকে আইন যানবাহন মালিক, চালক, পথচারী, যাত্রী, পুলিশসহ সবাইকে জানাতে হবে। তাদের তা জানতে হবে এবং মানতে হবে। কারও ক্ষেত্রে অমান্য লক্ষ করা গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।