আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাস পূর্তি হয়েছে গত ৮ আগস্ট। দেশের ক্রান্তিকালে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। জনগণের বিপুল প্রত্যাশা এ সরকারের কাছে। সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম থেকে রেহাই পাওয়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। স¤প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মাসিক ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) প্রকাশ করেছে। এ সূচকের ভিত্তিতে বণিক বার্তা জানাচ্ছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম মাসেই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হয়েছে। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগস্টে প্রায় ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে তা ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমেছে। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও। আগস্টে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, জুলাইয়ে যা ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এটা নিঃসন্দেহে আশা জাগানিয়া বিষয়। বিগত দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে বিরাজমান মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে এ সরকার। সাধুবাদ জানাই। তবে নিত্যপণ্যের বাজারদরের ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতাও থামানো দরকার। তা না হলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বাজারের বাস্তব চিত্র অনুযায়ী বর্তমানে কেবল মূল্যবৃদ্ধির হার কমছে পণ্যের দাম কমেনি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাজারে নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল। ওই সময় বাজারে কোনো সিন্ডিকেট ও সড়কে চাঁদাবাজি না থাকায় সবজির দাম অনেক কমেছিল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই ফের বাড়তে শুরু করে দাম। বর্তমানে বাজারে চাল ও ডিমসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট বাজারে মোটা চালের কেজি ছিল ৫২-৫৫ টাকা, যা মাসের শুরুতে ছিল ৫০-৫৪ টাকা কেজি। একইভাবে মাঝারি ও সরু চালের দামও কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছিল। গত মাসের শুরুতে ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ৪৮-৫২ টাকায় বিক্রি হলেও মাস শেষে ৫০-৫৩ টাকায় ওঠে। একই সময় রুই মাছের দামও ৩০০-৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০-৪০০ টাকা হয়। বিবিএসের সিপিআইয়েও সাধারণ ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, স¤প্রতি দাম বাড়ার প্রধান কারণ বন্যা ও সরবরাহ সংকট। যদিও বাজার বিশ্লেষক এবং খুচরা বিক্রেতাদের মতে এ দায় মজুদকারীদের কারসাজির। বাজার বিশ্লেষক ও খুচরা বিক্রেতাদের এ কথা উপেক্ষা করা যায় না। দেশে চাল সর্বস্তরের মানুষের জন্য অপরিহার্য একটি খাদ্যশস্য। কেবল চালের উৎপাদন ও মজুদ বিবেচনায় নিলে তাদের কথার সত্যতা মেলে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন, যা বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া গত বোরো মৌসুমেও রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়। ২ কোটি ২২ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয় ২ কোটি ২৪ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬৬ টন। এর মধ্যে চাল ছিল ১৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩৭ টন। প্রায় এক মাস আগে ৭ আগস্টও চালের মজুদ ছিল ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন। অর্থাৎ দেড় লাখ টনের বেশি মজুদ বেড়েছে। তবে মজুদ বাড়া সত্তে¡ও এ সময়ে খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে। রেকর্ড উৎপাদনের পরও এভাবে ক্রমেই চালের মূল্যবৃদ্ধি বাজারের অব্যবস্থাপনাকেই নির্দেশ করে। দুই অংকের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতি কমাতে ও ঋণাত্মক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজি ও কারসাজি বন্ধের বিকল্প নেই। বাজারের এ বেহাল দশা আজকের নয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশে উৎস থেকে পণ্য পাইকারি বাজার পর্যন্ত আসতে বেশ কয়েকবার হাতবদল হয় এবং প্রতি হাতবদলের সঙ্গে বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিদায়ী আওয়ামী সরকারের ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমনকি প্রশাসনের লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। একদিকে তারা পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদের কথা বলতে থাকে, অন্যদিকে বাজারে দাম বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি এতই জটিল হয়ে ওঠে যে সরকার নিজেই দাম বেঁধে দিয়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামিয়ে বাজারে অভিযান ও তদারকি বাড়িয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারেনি।
এ সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতার কারণেই দেশের জনগণ তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে যদি ভঙ্গুর বাজার ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না হয় তা কেবল হতাশারই জন্ম দেবে। তাই বর্তমান সরকারকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে এবং কাজের প্রতিফলন বাজারে দেখানো জরুরি। এর আগেও আমরা দেখেছি মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। তবে বাজারে শৃঙ্খলা না থাকায় তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। তবে সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ হিসেবে একটি বিষয় নিশ্চিত করা আবশ্যক- সঠিক সরকারি পরিসংখ্যান। কেননা সঠিক তথ্য ছাড়া নীতি কার্যকর না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। নিত্যপণ্যের দাম না কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো বিবিএসের পদ্ধতিগত সমস্যা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফুড বাস্কেটের পরিবর্তনও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখাতে প্রভাব রাখতে পারে। পরিসংখ্যানের এ দুর্বলতা দূর করতে প্রয়োজনে বিবিএসের সংস্কার করতে হবে।