না বলা কথা-২

1

আ জ ম সামশুল হক

মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। জীবন গড়ার ক্ষেত্রে মানুষ স্বপ্ন বুনে এবং তা হতে হয় বাস্তবধর্মী। এক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয় এবং পরিকল্পনা থাকতে হয়। সদইচ্ছা, দৃঢ়তা চেষ্টা এবং আত্মবিশ্বাস হচ্ছে, জীবন গড়ার বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে কোনটির ব্যত্যয় ঘটলে, জীবনের স্বপ্ন পূরণ কঠিন হয়ে পড়ে এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই একজন স্বপ্নের মানুষ, দৃঢ়প্রত্যয়ী একটি জীবনের কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি হচ্ছেন, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ড নিয়ে অনেকে স্বপ্ন বুনেছিলেন। তন্মধ্যে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, আবদূর রশিদ তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবুর রহমান সহ আরো অনেকে। তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য এবং তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী। তাঁর কঠোর পরিশ্রম, সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বপ্নের সিঁড়িতে ছিলেন। বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের মানুষের দুঃখ-দূর্দশা লাগবের জন্য তিনি জীবন বাজি রেখে জনগণের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। জীবনের স্বপ্ন ছিল, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, শোষণমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত এবং দারিদ্র্যমুক্ত একটি দেশ গড়ে তোলা। তাঁর লক্ষ্য ছিল, নতুন একটি পতাকা উন্মোচন করা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক, মেহনতী মানুষ এবং ছাত্র-জনতা সবাই স্বাধীনতার পক্ষে একাকার হয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে পুরো দেশ প্রকম্পিত করেছিলেন। আমরা পেয়েছি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের ৫ডিসেম্বর মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে এক আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান এই অঞ্চলটির নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’। যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে বিশ্বে পরিচিত। তিনি আমাদের একটি সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো দিয়ে গেছেন। দেশ বিনির্মাণে তিনি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি প্লাটফর্ম (মঞ্চ) তৈরি করেছেন। সেই মঞ্চে আজ আমরা অনেকেই কলা কুশলী এবং অনেকে অনেকভাবে নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছি। কালের বিবর্তনে এই দেশে স্বপ্নবিহীন কতেক সরকার এসেছে। সবাই নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ শাসন করেছেন। কম-বেশি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। দেশের অগ্রগতি এবং মানুষের জীবন মান নের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা নিজেরা ভাল বলতে পারবেন। তবে নিজেদের ব্যাপারে ষোলকলা পূর্ণ করেছেন নিঃসন্দেহে। ইতিহাসের পাতায় সব সরকারের কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ।
বলাবাহুল্য, বিগত সরকার বেশিদিন এই দেশ শাসন করেছেন। দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবন মান উন্নয়নের জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশ্বদরবারে সমাদৃত হয়েছেন।
বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। যা আমাদের জন্য অহংকার এবং দেশের জন্য গৌরবের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বেশ কিছু অসাধু প্রকৃতির মানুষের লোভ লালসা, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দুর্নীতি তথা লুটতরাজেরকারণে দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যা অন্যান্য সরকারের তুলনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।এই অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অধিক সময়ের প্রয়োজন এবং দেশের মানুষকে করেছে হতবাক। অতঃপর ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আকস্মিক এই সরকারের আবির্ভাব জনগণেত মধ্যে আলোর সঞ্চার করে এবং আশাবাদী হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ছয় মাস পার হতে চলে, জনকল্যাণে এই সরকারের কোন কর্মজজ্ঞ আমাদের নজরে আসেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই সরকার রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নন। সংবিধানের আলোকে হলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে এই সরকারের জন্ম। উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা প্রধানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই সরকারের উন্মেষ ঘটে। এই সরকারের কোন রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা নেই এবং মেয়াদের ব্যাপারটিও প্রশ্নবোধক। বলতে গেলে, বাইরে অবস্থানরত সমন্বয়কদের উগ্রবাদী কর্মকাÐ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি নিজেদেরকে করছে বিতর্কিত। তারা দেশে কোন গণতান্ত্রিক ধারা এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রয়োজন বোধ করেনা। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার কারণে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
সত্যিকার অর্থে, এই সরকারের ভিতরে মাননীয় কতেক উপদেষ্টা এবং ছাত্র সমন্বয়কদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে তা প্রমাণিত। রাজনৈতিক দর্শন না থাকার কারণে সহনশীলতার অভাব পরিলক্ষিত। বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব ও তাদের কাছে হার মানায়। বস্তুত: এই সরকারের আমলে গণতান্ত্রিকভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বন্ধ বলা চলে। দরিদ্র জনগোষ্ঠি তথা অবহেলিত মানুষের জন্য বরাদ্বকৃত নির্ধারিত ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের কথা নাই বা বললাম। ব্যাবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাংতে না পারলে আগত রমজানে জনগণের হবে নাভিশ্বাস।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দৃশ্যমান। উল্লেখ্য, এই সরকারের কর্মযজ্ঞ মূলত সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় না এনে বিনা অপরাধীদের নামে গায়েবি মামলার জট জনগণকে অবাক করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সময়ের বিবেচনায় আমরা এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলাম। বর্তমানে এই সরকারের প্রতি জনসমর্থন শূন্যের কোটায়। কারণে অকারণে এই সরকারের শাসন আমল দীর্ঘায়িত করতে চায়। পরিশেষে বলবো, আমরা জনগণের সরকার তথা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই এবং নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। শুরুতে বলেছি, সবাই নাটক মঞ্চস্থ করেন। জনগণের মধ্যে কিছুদিন প্রভাব বিস্তার করে বৈকি। সবাই দেশকে নিয়ে ভাবেন, তবে তার মধ্যে জনআকাঙ্খার প্রতিফলন থাকেনা। এই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন একজন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে আমরা স্মরণ করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক