নাশকতা প্রতিরোধে কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র (প্রতিমন্ত্রী) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। কমিটিতে এলাকার মসজিদগুলোর ইমাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের সদস্য করে প্রতি মাসে সভা করার নির্দেশ দেন তিনি।
গতকাল রবিবার সকালে লালদীঘি পাড়স্থ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে চসিকের ৬ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের ৪২তম সাধারণ সভায় মেয়র এ নির্দেশনা দেন। মেয়র বলেন, সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে দেশি-বিদেশি কিছু অপশক্তি মিলে দেশকে অকার্যকর করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী ভূমিকার কারণে এই অপচেষ্টা প্রতিহত করা গেছে। আমি ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতি করছি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছি। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের যে কার্যক্রম তাকে কোনভাবেই আন্দোলন বলতে পারি না। এটা ছিল রাষ্ট্রধ্বংসের আন্দোলন। নাহলে, সেতু ভবন, মেট্রোরেল স্টেশন, হানিফ ফ্লাইওভার, বিটিভি, পুলিশ বক্স এগুলো কী দোষ করেছে? এগুলো কেন ধ্বংস করা হলো? আন্দোলনের নামে টোকাই, ভাড়া করা লোক, বেকার যুবকদের দিয়ে দেশজুড়ে নাশকতা চালানো হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমাদেরও কিছু নৈতিক দায়িত্ব আছে। জনগণের জান-মাল রক্ষায় কাউন্সিলররা প্রতিটি ওয়ার্ডে নাশকতা প্রতিরোধে অরাজনৈতিক কমিটি গঠন করুন। কমিটিতে এলাকার মসজিদগুলোর ইমাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের সদস্য করে প্রতি মাসে সভা করে এলাকার মানুষদের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালান। নাশকতামূলক যে কোন কার্যক্রমকে তৃণমূলেই রুখে দিন।
মেয়র কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রমের গতি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে বলেন, বর্ষা চলে এসেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। কাউন্সিলররা বিষয়টি তদারকি করবেন। লোক সঙ্কট থাকলে তাও জানাবেন। তবে, লোক আছে ৫০জন, কাজ করবে ৩০জন, বাকীরা কাজ না করে বেতন খাবে তা হবে না। যারা কাজ না করে বেতন নিচ্ছে তাদের তালিকা করে অব্যাহতি দেয়া হবে।
অবৈধ হকারদের উচ্ছেদে আবারো অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়ে মেয়র বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতায় হকারদের ভূমিকা কী তা চট্টগ্রামবাসী দেখেছে। সহিংসতা নিয়ে প্রশাসনের ব্যস্ততার সুযোগে নিউ মার্কেট মোড়ে আবারও হকাররা রাস্তা দখল করে বসেছে। আমি আবারও নিউ মার্কেট মোড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে জনগণকে জনগণের সড়ক ফিরিয়ে দেব। ট্রাফিক বিভাগের সাথে বসে ব্যাটারি রিকশা বন্ধে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। মাদকের বিস্তাররোধে প্রয়োজনে পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেব। যানজট নিরসনে আগ্রাবাদে পে-পার্কিং চালু করেছি । পার্কিং বাড়াতে আরো পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীকে সাজাচ্ছি। স্বাধীনতার পর থেকে কোন পরিষদ এত বাজেট আনতে পারেনি। প্রধান প্রকৌশলী আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরবেন। আমি কোনভাবে নি¤œমানের কাজ মেনে নেব না। সম্প্রতি আলোকায়নের যে প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তা বাস্তবায়নে চুয়েটকে দায়িত্ব দেয়া হবে পোল থেকে লাইট সবকিছুর মান যাচাইয়ের বিষয়ে। আমি টেকসই উন্নয়ন চাই। যে সমস্ত সড়কের নামকরণ করা হয়নি এবং নতুন যেসব সড়ক নির্মাণ করা হবে সেগুলোকে চট্টগ্রামের বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণের ঘোষণা দেন মেয়র। মেয়র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সবগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সুচিকিৎসা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে বলেন।
সিডিএ’র প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসণে সিডিএ’র প্রকল্প সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করছে। তবে, কাজের বিষয়ে আপনাদেরই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং, প্রকল্প দ্রæত শেষ করার বিষয়ে কাজ করুন। বহদ্দারহাটে চাঁন মিয়া রোডে মানুষ হাটতে পারছে না। এলাকাবাসী দল বেঁধে আমার কাছে এসে জানিয়েছে রাস্তার অনেক জায়গায় খালের মতো গর্ত। তারাতো সিডিএ চিনে না মনে করে একাজের দায়িত্বও আমার। আপনারা কাউন্সিলরদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করুন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে মেয়র বলেন, পাহাড়খেকো, পুকুরখেকোদের বিরুদ্ধে আপনারা ১৯৪টা মামলা করছেন বলছেন। কিন্তু মামলা করে কোন লাভ নেই। আপনার মামলার রায় আসতে আসতে বহুতল ভবন হয়ে যায়। আসকার দীঘি, ভেলুয়ার দীঘিসহ চট্টগ্রামের বহু জলাশয় দখল হয়ে যাচ্ছে। আপনারা উচ্ছেদ অভিযান চালান, মামলা-জরিমানা করে লাভ নেই। আপনারা পরবর্তী সভায় প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন আপনাদের কার্যক্রমের অগ্রগতির বিস্তারিত জানাবেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি সিনিয়র কেমিস্ট রুবাইয়াত তাহরীম সৌরভ পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের অভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না জানালে মেয়র জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করার নির্দেশনা দেন।
সভায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি এসি (কোতোয়ালী) অতনু চক্রবর্তী বলেন, জনগণের নির্বিঘœ চলাচল নিশ্চিতে অবৈধ হকার উচ্ছেদ ও উচ্ছেদের পর উদ্ধারকৃত স্থান মনিটরিং করার জন্য ১৬টি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪৬টি স্থানে সাইনবোর্ড নির্মাণে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অবৈধ ব্যাটারি রিকশা আটক করে ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নাশকতা মোকাবিলায় গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে।
নগরীতে ছিনতাই ও মাদকের বিস্তার রোধে পুলিশকে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর পরামর্শ দেন কাউন্সিলররা।
ওয়াসার প্রতিনিধি নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রউফ বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই ইম্প্রুভম্টে প্রকল্প একনেকে পাশ ও বাস্তবায়িত হলে নগরীর ৪০ ও ৪১ নং ওয়ার্ডে সুপেয় পানির হাহাকার থাকবে না। মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ওয়াসার যে কার্যক্রম চলছে তা শেষ হলে চট্টগ্রামের পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।
এসময় একাধিক কাউন্সিলর ওয়াসার প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ওয়াসা নতুন সড়ক করার পর কেটে ফেলছে। চসিক সড়ক নির্মাণের সময় সড়কের নীচে ম্যাকাডম, বালু, ইট, পাথরসহ যেসব নির্মাণ সামগ্রী দেয় ওয়াসার ঠিকাদাররা রাস্তা কাটার পর তা নিয়ে যান এবং কাজের পর সাধারণ মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করে দেন। ফলে, বর্ষার সময় সেই মাটি নীচু হয়ে রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায় এবং নাগরিকদের সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ হয়। কাউন্সিলররা ওয়াসাকে কোন রাস্তা কাটার আগে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সভায় চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আমিন, প্যানেল মেয়রবৃন্দ, কাউন্সিলরবৃন্দসহ চসিকের বিভাগীয় ও শাখা প্রধানগণ এবং নগরীর বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিজ্ঞপ্তি