হঠাৎ বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি জাহাজে পর পর বিস্ফোরণ এবং হতাহতের ঘটনায় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এলাকায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। বিএসসি কর্তৃপক্ষ ৫দিনের ব্যবধানে দুটি জাহাজে বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনাকে স্বাভাবিক নয় বলে উল্লেখ করে একে নাশকতা সন্দেহ করে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছেন। সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর, শুক্রবার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)’র মালিকানাধীন অয়েল ট্যাংকার ‘বাংলার সৌরভ’ বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়েছে। এসময় বিস্ফোরণের আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে ১ জনের মৃত্যু হয়, ৪৮ ক্রু প্রাণে বেঁেচ যায়। তান্ডবে পরিবহনে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। এ ঘটনার ৫দিন আগে বিএসসির আরেকটি তেলবাহি জাহাজ বিস্ফোরিত হয়। দেশের জ্বালানি তেল লাইটারিং কাজে নিয়োজিত দুটি অয়েল ট্যাংকার বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডে অচল হয়ে পড়াকে নাশকতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘিœত করতে কোনো চক্র বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের দুটি জাহাজকে টার্গেট করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত শনিবার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিপিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে দেশের জ্বালানি সেক্টরের শীর্ষ কর্মকর্তারা গতকাল বিকালে জুম মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানেও এমটি বাংলার সৌরভে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডের ঘটনা স্বাভাবিক নয় বলে আলোচিত হয়েছে। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য বিএসসি একটি ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকার ভাড়া নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঘটনা তদন্তে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসসি। সূত্র জানায়, গতকাল রবিবার পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান এবং পরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম আসছেন। সূত্রে জানা যায়, দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের প্রায় পুরোটা আমদানি নির্ভর। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে পরিশোধিত অপরিশোধিত অবস্থায় এসব তেল আমদানি করা হয়। বিদেশ থেকে আনা এই তেলের বেশিরভাগ আসে বড় বড় অয়েল ট্যাংকারে। এসব ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী ট্যাংকার থেকে বিএসসির জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ জ্বালানি তেল লাইটারিং করে গুপ্তাখাল জেটিতে এনে জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপোতে খালাস করে। দেশে কেবলমাত্র দুটি অয়েল ট্যাংকার বহির্নোঙর থেকে তেল খালাস ও পরিবহন করে। বিপিসি ও বিএসসির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় তেল খালাস ও পরিবহন করা হয়। এমটি বাংলার জ্যোতিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় গত শুক্রবার রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে দ্বিতীয় জাহাজ বাংলার সৌরভেও একইভাবে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুটি ঘটনায় দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য রয়েছে। বাংলার জ্যোতিতে আবদ্ধ জায়গায় কাজ করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। আর বাংলার সৌরভে একসাথে চারটি পয়েন্টে আগুন দেখা দেয় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। ওই সময় জাহাজে কোনো মেরামত কাজ চলছিল না। গভীর রাতের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাÐের পর নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আগুন নিভানোর কাজ করে। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাÐের সময় জাহাজটির ক্যাপ্টেনসহ নাবিকদের অনেকে সাগরে ঝাঁপ দেন। কোস্টগার্ডের উদ্ধারকারী দল ৪৮ নাবিককে উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাদেক মিয়া নামে এক নাবিককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৮৭ সালে ডেনমার্ক থেকে কেনা বাংলার সৌরভের আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে আরো দশ বছর আগে। বিএসসি ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজটিকে সংস্কার করে পরিচালনা করে আসছিল। বাংলার জ্যোতির মতো এটিও শুধু বহির্নোঙর থেকে বন্দরের ডলফিন জেটিতে জ্বালানি তেল পরিবহন করত। শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনায় জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জাহাজে থাকা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা দামের ক্রুড অয়েল অক্ষত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি টন ৬শ ডলার দরে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েলগুলো বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগ্যাসি থেকে খালাস করে বাংলার সৌরভ বন্দরের ডলফিন জেটিতে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। আগুনে জাহাজটির ব্যাপক ক্ষতি হলেও হ্যাজ অক্ষত রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, সাগর উত্তাল, তাই বাইরের কাউকে জাহাজটির কাছাকাছি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে দূর থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে জাহাজটির সামনের অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেখা গেছে। সূত্র জানায়, জাহজটির তেল আনলোড করার পর এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হতে পারে। আমরা মনে করি, বিএসসির মালিকানাধিন জাহাজ দুটি বিস্ফোরণ নিয়ে যায় ভাবা হোক, বাস্তবতা হচ্ছে, তেলবাহি গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ দুটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে অনেক দেরি হয়েছে। এরপরও জাহাজ দুটি ব্যবহার করা তাতে বহির্নোঙ্গর থেকে তেল আনা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।