গত ৮ মার্চ দেশে ব্যাপক আয়োজনে যখন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন চলছে, তখন মাগুরায় আট বছরের শিশু আছিয়ার উপর নরপিচাশদের যৌন বর্বরতা চলছিল। পবিত্র রমজানের মাস সেহরির সময় ডেকে নিয়ে নিজের বোনের শ্বশুর নির্মম ঘৃণ্য বর্বরতা চালায়। সবচেয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় এ ঘটনা বোনের জামাই ও শাশুড়ি (নরপিচাশের ছেলে ও মা) জানতেন। এরপর ঘটনার নির্মমতায় হতবিহবল বোন শিশুটিকে হাসপাতালে হাসপাতালে নিয়ে যান। তার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। বোনটি বলেছে, বিয়ের পর শ্বশুরের দ্বারা তিনিও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিলেন। তখন স্বামী এবং শাশুড়ি ধর্ষণকারী শ্বশুরের পক্ষ নিয়েছেন। একটি পরিবারের প্রধান ব্যক্তির চরিত্র যদি এ অবস্থা হয় সেই পরিবার ও সমাজের অবস্থা কী? বলা দরকার আছিয়ার বোন যখন নিজের শ্বশুরদ্বারা যৌন নীপিড়নের স্বীকার হয়েছেন তখন তার উচিৎ ছিল আইনের আশ্রয় নেয়, কিন্তু তিনি তা করেননি। হয়ত তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাধা দিয়েছেন অথবা ধৈর্য্য ও সহ্য করে স্বামীর ঘরে রয়ে গেছেন-যেটি আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। তবে বড়বোন যদি প্রতিবাদী হতেন কিংবা আইনের আশ্রয়ে যেতেন তবে আছিয়াকে হয়ত এ বর্বরতার শিকার হতে হতো না। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে আমাদের প্রিয় মাতৃভুমিতে যা ঘটছে, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা যে সমাজে বাস করছি, সেটা কি ক্রমেই অমানবিক হয়ে যাচ্ছে? এ রকম ভ্রষ্ট ধর্ষক তো সমাজে একটিই নয় এবং এ ঘটনা যে নতুন করে হচ্ছে তা নয়। সুদূর অতীত থেকে এদেশে প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামের জনপদেও নারী নির্যতন ও যৌন নীপিড়নের ঘটনা ঘটে আসছে। কিন্তু প্রশাসন ও সমাজ যেন নির্বিকার। এসব পাষÐ ও নরপিচাশদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ নেই কেন? পারিবারিক আর সামাজিক শিক্ষায় কি শিথিলতা এল? না হলে এ ধরনের নৃশংসতা রোধ করা যাচ্ছে না কেন?
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশে নারী সমাজ একেবারেই নিরাপদ নয়। উন্মুক্ত স্থানে, গাড়িতে কিংবা জনপদগুলোতে অস্বস্তি আর ভয় বুকে নিয়ে চলতে হচ্ছে নারীদের। কারা কোন দিক থেকে তাদের হেনস্তা করবে, তা কেউ আগাম বলতে পারে না। এ রকম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে যদি নারীদের থাকতে হয়, তাহলে সমাজের চাকাটা সামনের দিকে চলছে না, সেটা বুঝতে হবে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করেও এক ব্যক্তি তথাকথিত ‘তৌহিদি জনতা’র ছত্রছায়ায় ছাড়া পেয়েছে এবং তাঁর হাতে দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআন, তাঁর গলায় দেওয়া হয়েছে ফুলের মালা! সেই ছাত্রী মামলা উঠিয়ে নিতেও বাধ্য হয়েছেন। এই যখন অবস্থা, তখন অভয়া কি সত্যিই বিচার পাবে? সংশয় যায় না। দেশে নারী নিপীড়নের ঘটনা দিন দিন উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী পোশাক নিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়ার পর মামলা করলেও, হুমকির কারণে তিনি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, বরং দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও নিপীড়নের গভীর সংকটের একটি প্রতিফলন। মেট্রোরেলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোচে পুরুষ যাত্রীদের প্রবেশ এবং তাদের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের যৌন নিপীড়নের ঘটনাও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি সেই ঘটনার প্রতিবাদ করা নারীদের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এসব ঘটনা ঘটলেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, নারীদের জন্য নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখনই জরুরি। নারী নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য কঠোর আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ জরুরি। নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলোর দ্রæত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে সমাজে একটি বার্তা যাবে যে এ ধরনের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
এছাড়া নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি ও আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা ও প্রচারণার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমতার বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুধু আইনি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং একটি নিরাপদ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য কাজ করা। সরকার, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে।