নারী অগ্রগতি যেনো থেমে না যায়

1

রতন কুমার তুরী

সেই আদিমকাল থেকেই সমাজব্যবস্থায় নারী স্বাধীনতার বিষয়টি যুগযুগ ধরে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন হলো কেনো এই নারী স্বাধীনতা নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা। প্রকৃতপক্ষে যুগযুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারী স্বাধীনতার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় কিছু সাহসি নারী সৃজনশীল লেখনির মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে একপর্যায়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সরব হতে থাকে। দূরঅতীতে নারীদের শুধুমাত্র ঘরের চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে হতো। ঘরের রান্নাবান্না এবং সন্তান লালনপালন করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজেই অন্তর্ভুক্ত করা হতোনা। এমনকী পাঁচজন পুরুষ একসাথে কথা বলার সময়ও নারীদের সেখানে যাওয়ার অধিকার ছিলনা এবং কোনো কাজেই নারীদের মতামত নেয়া হতোনা। একথায় বাড়ির অন্দরমহলই ছিল নারী জীবনের শেষ ঠিকানা। একসময় নারীরা যে লেখা-পড়া করবে সেই বিষয়টিও ছিল দূর অস্ত। নারীদের মধ্যে তাদের স্বাধীনতা বিষয়ে জাগরণ ঘটাতে যে ক’জন মহিয়ষী নারী এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে ছিল- বেগম রোকেয়া সাখাওত, বেগম সুফিয়া কামাল, প্রীতিলতা ওর্য়াদ্দেদার প্রমুখ। বেগম রোকেয়া সাখাওত তার লেখনির মাধ্যমে মূলতঃ বাংলার নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই বিযয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওত এর লিখিত বই ‘অবরোধ বাসিনী’ এবং ‘সুলতানাস ড্রিম’ পড়লে আজকের নারী সমাজ বুঝতে পারবে আজকের নারীদের এপর্যায়ে আনতে বেগম রোকেয়া সাখাওতদের কতইনা কষ্ট করতে হয়েছে। বেগম সুফিয়া কামাল বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম মেধাসম্পন্ন কবি ছিলেন। বেগম সুফিয়া কামালকে সেসময়ে সাহিত্য চর্চা করে কবি পর্যায়ে আসতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
প্রীতিলতার ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনের কথা আমরা সবাই জানি কিন্তু আমরা যেটা জানিনা প্রীতিলতাকে এই আন্দোলনে সামিল হতে কতটা পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়েছিল। এইসব মহিয়ষী নারীরা যদি নারী স্বাধীনতার বিষয়ে তৎকালিন সময়ে এগিয়ে না আসতো তাহলে হয়তো আজকের নারী সমাজ তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে আরো অনেক সময় লেগে যেতো। মূলতঃ মধ্যযুগ পর্যন্ত নারী স্বাধীনতার বিষয়টি একেবারে অজানা এবং অচেনা একটি ধারণা ছিল। আধুনিক যুগের প্রথম দিকেও ইউরোপের কয়েকটা দেশ ছাড়া নারী সমাজ তেমন একটা এগিয়েছিলনা, পরবর্তিতে নারী সমাজ আস্তে আস্তে তাদের অধিকারগুলো সম্পর্কে বুঝতে শিখলে শিক্ষা-দীক্ষায় মনোযোগি হতে লাগলো এবং পুরুষদের মতো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়াতে লাগলো। ঠিক এভাবে আস্তে আস্তে নারীরা তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে লাগলো। বর্তমানে নারী সমাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীরা বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান রেখে চলেছে। গার্মেন্টস সেক্টরে নারীদের অবদান অভাবনীয়। এই সেক্টরে নারীরাই বাংলাদেশে স্বর্ণ যুগের সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ গার্মেন্টস সেক্টর থেকে বছরে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট অবদান রেখে চলেছে। গার্মেন্টস ছাড়াও নারীরা এদেশের মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, শিক্ষক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, সাংবাদিক, এনজিও এবং বিভিন্ন অফিস আদালতে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে নারীদের ছাড়া তাদের দেশের এবং সমাজ উন্নয়নের কথা তারা চিন্তাই করতে পারেনা।
ইউরোপ, আমেরিকার মত দেশ সমূহে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে পুরুষের চেয়ে। কর্মদক্ষতা দিয়ে সেসব দেশের নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে অনেক আগেই আর তাই ওসব দেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। প্রকৃতপক্ষে নারীপুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করতে পারলে যেকোনো দেশ এগিয়ে যাবেই কারণ দেশের একটা বৃহৎশ্রেণিকে বাদ দিয়ে কোনো দেশের উন্নয়নের চিন্তা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে
বাংলাদেশে গ্রামের চেয়ে শহরের নারীরা এগিয়ে কারণ শহরে নারীদের কাজের ক্ষেত্র ব্যাপক এবং শহুরে সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের চলাফেরা, শিক্ষাধীক্ষায় যথেষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে আর শহরের আইনশৃঙ্খলার দপ্তরগুলো একেবারে কাছাকাছি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলাও ভালো, অন্যদিকে গ্রামিণ পর্যায়ে নারীদের কাজের ক্ষেত্র কম হওয়ায় এবং অনেক সময় রক্ষনশীল সমাজে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ মেয়েদের অগ্রগতিকে জোড় করে থামিয়ে দিতে রত থাকায় তারা পিছিয়ে পড়ছে। তবুও ইদানিং অনেক নারীই গ্রাম থেকে শহরে এসে চাকরি করছে এবং পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের বলয় ভেঙ্গে এভাবে যুগেযুগে নারীরা এগিয়ে এসেছে এবং সামনেও এগিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে লেখা-পড়া শিখে শিক্ষিত হওয়া। একজন শিক্ষিত নারীই পারে আর দশজন নারীর মনের অন্ধকার দূর করে দিতে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এবিষয়ে সরকারেরও কিছু করণীয় রয়েছে, সরকার
চাইলে সব অফিস আদালতে নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যে পরিবেশে নারীরা নির্বিঘেœ তাদের কর্মকাÐ চালাতে পারবে, যে পরিবেশে কাজ করতে নারীরা কোনো ধরনের বাঁধার সম্মুখীন হবেনা নির্ভয়ে কর্মস্থলে আসতে এবং যেতে পারবে। অনেক সময় আমরা লক্ষ করি কিছু বখাটে ছেলে মেয়ে কিংবা নারীদের প্রতি খারাপ মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং ইভটিজিং-এর মত অমানবিক কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে, নারীদের প্রতি এমন কর্মকান্ড দেখলে সাথে সাথে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ইভটিজারদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মূলকথা হচ্ছে এদেশের নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাদের যথেষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে এবং সারা দেশে গড়ে তুলতে হবে নারীবান্ধব পরিবেশ।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক