নারীর অনাকাক্সিক্ষত গর্ভপাত নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

1

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ

যেকোনও দম্পতির ক্ষেত্রেই মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। দুর্ভাগ্যবশত শতকরা দশ থেকে পনের জন দম্পতিকে এই বেদনাদায়ক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। বিষয়টি শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই একজন নারীকে বিপর্যস্ত করে। গর্ভধারনের পর ২৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশু অনাকাক্সিক্ষতভাবে নষ্ট হওয়াকে বলা হয় গর্ভপাত। যদি পরপর দুটি বা তার বেশি গর্ভপাত হয়, তাকে বলা হয় রেকারেন্ট অ্যাবরশন বা ঘন ঘন গর্ভপাত।

গর্ভপাতের কারণ :
* ৬০ শতাংশ গর্ভপাত হয় ভ্রুণের ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতার কারণে।
* গর্ভাবস্থায় প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে হওয়া গর্ভপাতের অন্যতম প্রধান কারণ হল ভ্রুণের জিনঘটিত ত্রুটি। স্ত্রী কোষ এবং পুরুষ কোষ সংযুক্ত হওয়ার সময় কিছু ক্ষেত্রে জিনগত বিন্যাস অসম হয়ে যায়। এর ফলে গর্ভপাত হতে পারে। বাবা- মাসের মধ্যে কোনও জিনঘটিত ত্রুটি না থাকলে এ জাতীয় গর্ভপাত বার বার হয় না।
* অন্যগুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ। মায়ের শরীরের যে কোনও সংক্রমন বা হাই-ফিভার থেকেও ঘটতে পারে গর্ভপাত।
* মায়ের অতিরিক্ত স্থুলতা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, সিফিলিস, নেফ্রাইটিস, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, জরায়ুর আকারে অস্বাভাবিকতা।
* ধুমপান, মদ্যপান, মাদক সেবন।
* বয়স্ক নারীদের (৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে) গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশি। ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা এবং ওষুধ অনেক সময় ঝুঁকি বাড়ায়।

গর্ভপাতের লক্ষণ বা উপসর্গ : অনেক ক্ষেত্রে কোনও উপসর্গ ছাড়াই ঘটতে পারে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্তস্রাব ও তলপেটে মোচড় দেওয়া ব্যথা গর্ভপাতের প্রধান লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়।
চিকিৎসকের করণীয় : গর্ভপাত ঘটে যাওয়ার পর কোনও ওষুধ প্রয়োগেই তাকে সুস্থ গর্ভাবস্থায় পালটে ফেলা সম্ভব নয়। ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে জরায়ু থেকে ভ্রণকে বের করে আনা এবং সুস্থ করে তুলতে হবে।

আনুষঙ্গিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পরামর্শ :
* মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের জন্য নিজেকে দোষী মনে করবেন না। আপনি অন্য কিছু করলে বা আরো বেশি সাবধান থাকলে হয়তো এ রকম পরিস্থিতি আসতো না, এই ধরনের চিন্তা মনে আনবেন না। এটা এমন একটা ঘটনা যাতে কারও কোনও হাত নেই। তাই আপনার দোষে এরকম হয়েছে মনে করে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। এতে কোনও লাভ হবে না। উল্টো আপনি কিছুতেই এই দুঃখটা ভুলতে পারবেন না। তাই নিজেকে কিছুটা সময় দিন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন, বই পড়ুন, গান শুনুন, বাড়ীর ছোট খাটো কাজ করুন, এতে মল ভাল থাকবে। পজিটিভ এনার্জি পাবেন। যে অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুণছিলেন তার হঠাৎ এই পরিণতি মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। তারপরেও কিন্তু তাও মন শক্ত করুন।
* গর্ভপাতের পরও সুস্থ বাচ্চা হতে পারে। একবার গর্ভপাতের পর দুবার সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেওয়ার হার প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯জনেরও বেশি। তাই হতাশ হবেন না। গর্ভপাতের তিন মাস পর পরবর্তী বাচ্চা নেওয়া যাবে। গর্ভপাতের পর রক্তপাত পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগে বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এতে সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ে। তাই একটি মাসিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
* খুব কম সংখ্যক দম্পতির ক্ষেত্রেই বারবার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই নিয়ে অযথা ভয় পাবেন না। প্রথম থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বাড়ির হালকা কাজ করতে পারেন। নিয়মিত অফিস যাওয়ার ক্ষেত্রেও কোনও সমস্যা নেই। তবে সব কিছুই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করবেন।
* গর্ভধারনের আগে থেকেই ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন-ই.সি. সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন, ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি, ফলমূল রাখুন।
পরীক্ষা নিরীক্ষা : বারবার গর্ভপাত হলে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এর কারণ বের করা দরকার। যেমন-রক্তের গ্রুপ, ব্লাড সুপার, ক্রোমোজোম পরীক্ষা, হাইভ্যাজাইনাল সোয়াব কালচার, আলট্রাসনোগ্রাফি, হিস্টোরোসকপি, হিসটিরোসালফিনগোগ্রাফি, ল্যাপরোস্কপি ইত্যাদি।

পরের প্রেগনেন্সি : মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর পরের প্রেগনেন্সির কথা ভাবুন। আগের মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের কারণ জানার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিন। নিয়মিত চেকআপ করান। মনে রাখবেন এর জন্য কিন্তু মানসিক এবং শারীরিক স্থিতি ভীষণভাবে প্রয়োজন।

হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত মোকাবিলায় হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত ফলদায়ক ওষুধ আছে। যা অন্য প্যাথিতে নেই। এই রোগ প্রতিকারে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কার্যকারিতা বহু প্রাচীনকাল থেকেই সন্দেহাতীতভাবে দৃঢ়তার সাথে প্রমাণিত হয়ে আসছে। লক্ষণ সাদৃশ্যে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিম্নলিখিত ওষুধ প্রয়োগ করে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। যথা ১) একোনাইট ন্যাপ ২) আর্নিকা মন্ট ৩) বেলেডোনা ৪) ক্যামোমিলা ৫) সিমিসিফিউগা ৬) কলোফাইলাম ৭) ইগ্নেসিয়া ৮) পালসেটিলা ৯) স্যাবাইনা ১০) সিকেলী ১১) আয়োডিয়াম ১২) সিপিয়া ১৩) ভাইবার্নাম অপি ১৪) ক্যালকেরিয়া ১৫) মার্কসল ১৬) মেডোরিনাম ১৭) এসিড নাইট্রিক ১৮) থুজা, ১৯) ক্রোকাস স্যাটাইভা ২০) পালসেটিলা ২১) কেলিকার্ব ২২) অরাম মিউর ন্যাট্রো ২৩) ফেরামমেট ২৪) হ্যামামেলিস ২৫) সালফার উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।
লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক