নানা সংকটে ধুঁকছে একমাত্র সরকারি শিশু পরিবার কেন্দ্র

1

কাউছার আলম, পটিয়া

মা-বাবা কিংবা বাবা হারা এতিম শিশুদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত মর্যাদায় সমাজে পুনর্বাসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি শিশু পরিবার কেন্দ্র। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে বৃহত্তর দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র সরকারি শিশু পরিবার (বালক) কেন্দ্রটির অবস্থান পটিয়া উপজেলায়। প্রায় দুই দশক ধরে সরকারি শিশু সদন বা শিশু পরিবার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা এবং শিশু আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে আসলেও প্রতিষ্ঠানটি নানান সংকটে জর্জরিত। বিশেষ করে জনবল সংকটে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। জনবল সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও।
১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এতিম শিশুদের পারিবারিক পরিবেশে স্নেহ-ভালোবাসা ও আদর-যত্নের সঙ্গে লালন-পালন করে সমাজে পুনর্বাসন করাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা সাধনে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পটিয়ায় সরকারি শিশু (বালক) পরিবার পরিচালনায় যে জনবল থাকার কথা তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ১০০ শয্যার এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে অবস্থান করছে ৪৭ জন এতিম শিশু।জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র সরকারি শিশু (বালক) প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের হুলাইন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১ একর ৫৮ শতাংশ জায়গার উপর প্রতিষ্ঠা করা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর। ৫ তলাবিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন, একটি দো’তলাবিশিষ্ট অফিস কাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, একটি অফিসার্স ও স্টাফ কোয়ার্টারসহ পানির পাম্প হাউজ, গার্ড শেড এবং ওয়েটিং রুম রয়েছে এখানে। এই শিশু সদনটির আবাসিক ভবনে ১০০ জন শিশুর থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছরে এ প্রতিষ্ঠানে ৪০৬ জন এতিম শিশু সুবিধা নিয়েছে। বর্তমানে এখানে ৪৭ জন শিশু অবস্থান করছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে পুনর্বাসিত হয়েছে ৩৬০ শিক্ষার্থী।
সরকারি শিশু (বালক) সদনটি পরিচলনার জন্য ১৮টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কাজ করছেন মাত্র ৭ জন। বাকী ১১টি পদ শূন্য দীর্ঘদিন। ফলে নিবাসটিতে শিশু-কিশোরদের দেখাশোনা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য একমাত্র উপ-তত্বাবধায়ক পদটিও শূন্য দীর্ঘ দিন ধরে। বর্তমানে যিনি কাজ করছেন মো. সোহানুর মোস্তফা শাহরিয়ার, তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই পদে আছেন।
এছাড়াও কারিগরি শিক্ষকের ২টি পদের মধ্যে আছেন ১ জন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের একমাত্র পদটিও শূন্য। শিক্ষার্থীদের দেখভাল করতে ‘বড় ভাইয়া’ পদের ২টির বিপরীতে আছেন ১ জন, আরেকজন সংযুক্তিতে। সহকারী শিক্ষকের ২টি পদের মধ্যে ১টি পদ শূন্য। কম্পাউন্ডার পদের ১টি মাত্র পদ, সেটিও শূন্য। বাবুর্চির ২টি পদের বিপরীতে একজন, অফিস সহায়ক ৫টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১ জন। খন্ডকালীন চিকিৎসক আছেন ১ জন। সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা প্রতিষ্ঠানটির। এভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে প্রতিষ্ঠানটি। দায়সারাভাবে চলা এ শিশু পরিবারটি কেমন প্রয়োজনীয়তা হারাচ্ছে। যদিও দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র জনবল সংকটের কারণে সেবার মান নিশ্চিত না হওয়ায় ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে বসবাসকারী এতিম শিশুদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৬ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৪ জন, পঞ্চম শ্রেণিতে ১ জন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ২ জন, সপ্তম শ্রেণিতে ৮ জন, অষ্টম শ্রেণিতে ৪ জন, নবম শ্রেণিতে ৫ জন, দশম শ্রেণিতে ৩ জন, এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ৪ জন, একাদশ শ্রেণিতে ২ জন, দ্বাদশ শ্রেণিতে ১ জন ও স্নাতকে পড়ছেন ১ জন শিক্ষার্থী। তারা সবাই পটিয়া ও তার আশেপাশের বিভিন্ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে অবস্থাস করা শিশুদের জন্য যে মাসিক বরাদ্দ তাও যুগোপযোগি নয় বলে জানা গেছে। এ নিবাসে থাকা শিশু বা বালক শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারিভাবে খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতে মাথাপিছু ব্যয় বরাদ্দ থাকে ৫ হাজার টাকা করে। এরমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি ব্যয় বাবদ ৪ হাজার টাকা, সাধারণ পোশাক পরিচ্ছেদ বাবদ ৩০০ টাকা, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ও খেলাধুলা সামগ্রী বাবদ ৩৫০ টাকা, চিকিৎসার জন্য ১০০ টাকা, তেল সাবান প্রসাধনি বাবদ ১৫০ টাকা ও প্রশিক্ষণ বাবদ ১০০ টাকা।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, আবাসিক এই শিশু সদনটিতে ৪টি আবাসিক ভবন রয়েছে। এসব ভবনের নামকরণ হয়েছে চট্টগ্রামের ৪টি নদীর নামে- কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি ও হালদা। প্রতিটি আবাসিক হলে থাকেন ২৫ জন শিক্ষার্থী। পাশাপাশি নামাজ, খাওয়া দাওয়া ও গোসলের জন্য আলাদা রুম রয়েছে। প্রতিদিন তিন বেলা খাবার ও একবেলা নাস্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোন দিন কোন বেলা কি খাবার পরিবেশন করা হবে তা লিস্ট আকারে ডাইনিং রুমে টানিয়ে দেয়া থাকে। এ নিবাসে মূলত যে সমস্ত শিশুর মা-বাবা কিংবা বাবা বা মা নেই- এই ধরণের শিশুরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ৭-৯ বছরের শিশুদেরকে ভর্তি করানোর নিয়ম এখানে। তবে, ভর্তির পর ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত রাখার নিয়ম থাকলেও যারা পড়াশোনা করতে চায় ও শিক্ষায় যুক্ত থাকে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা জীবন শেষ না হওয়া পর্যন্তও রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে শিক্ষা দপ্তর থেকে সরকারি এতিমখানাগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই স্টেট অরফানেজ বা সরকারি এতিমখানাগুলোকে পরবর্তী সময়ে সরকারি শিশু সদন হিসেবে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে পারিবারিক পরিবেশে এতিম শিশুদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সার্বক্ষণিক তত্বাবধান ও সাহচার্য দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিপালনের জন্য শিশু সদনগুলোকে সরকারি শিশু পরিবারের রূপান্তরিত করা হয়েছে। ১৯৪৪ সালের এতিমখানা ও বিধবা সনদ আইন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের বিধান মোতাবেক পিতৃ-মাতৃহীন বা পিতৃহীন এতিম ও দুস্থ শিশুদের পূর্ণমর্যাদা দেয়া, তাদের অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়। অধিদপ্তরের পরিচালক ও কর্মকর্তারা সদর দপ্তর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে তত্ত¡াবধায়করা সরকারি শিশু পরিবার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠ পর্যায় ও সদর দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে শিশু পরিবার পরিচালনার জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি শিশু পরিবারের তত্বাবধায়ক এই কমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে কাজ করেন। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদাধিকার বলে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। বিরাজমান নানা সমস্যা এবং আর্থিক বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে সেখানে অবস্থানকারী প্রায় অর্ধশতাধিক শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। সরকারি স্বল্প বরাদ্দ দিয়েই এসব শিশুদের খাদ্য-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষকে।
পটিয়া শিশু পরিবার (বালক) উপতত্বাবধায়ক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সোহানুর মোস্তফা শাহরিয়ার এক বছর ধরে এ পদে আছেন। তিনি বলেন, শিশুদের দেখভালের জন্য ১৮টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র সাতজন। সহকারী শিক্ষক, কম্পিউটার ম্যান, বাবুর্চিসহ জরুরি পদগুলোয় জনবল নেই কয়েক বছর ধরে।
চট্টগ্রামের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল আলম বলেন, জনবল যা আছে, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেলাই, কম্পিউটার সার্ভিসিং, মোবাইল সার্ভিসিংসহ আরো অন্যান্য প্রশিক্ষণগুলো শিশু পরিবারগুলোয় দেওয়ার কথা থাকলেও পটিয়ায় প্রশিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখতে হয়েছে।
জেলার এ কর্মকর্তা আরও বলেন, জনবলসহ অন্যান্য সমস্যা শুধু পটিয়ায় নয়, চট্টগ্রাম বিভাগের আটটি শিশু পরিবারে এ সমস্যা রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলা হয়েছে। অধিদপ্তরের ডিডি সম্মেলনেও বিষয়টি নিয়ে বলা হয়েছে। এসবের কারনে আমরা প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছি না। স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।