নাজিরহাটের প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্টগ্রামে প্রথমে ইপিআর-এর অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বিদ্রোহ করেন এবং কোন দিক থেকে যাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য শহরের চারিদিকে ইপিআর মোতায়েন করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ সৃষ্টি করেছিলেন। পরে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে তাঁর সৈন্যদের কালুরঘাটে নিয়ে গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ সৃষ্টি করেন এবং তিনি বোয়ালখালী চলে যান। কালুরঘাটের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত টিকে ছিলো; কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী আহত হন এবং লে. শমসের মুবিন চৌধুরী আহত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও হাটহাজারীতে ৭০-এর নির্বাচিত সংসদ সদস্য এম এ ওহাবের নেতৃত্বেস্থাপিত প্রতিরক্ষা ব্যুহও পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য হলেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলো। সংঘটিত প্রতিরোধ যুদ্ধও কার্যকরী হয়েছিলো। তাঁরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেছিলেন। সেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার পর যেখানে চাপ পড়েছিলো, সেটি হচ্ছে নাজিরহাট প্রতিরক্ষা ব্যুহ। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সোলায়মান, যাঁর কথা বলতে এই নিবন্ধের অবতারণা, তিনি নাজিরহাট প্রতিরোধ ঘাঁটির অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। ষাটের দশকের অন্তিমে চট্টগ্রাম শহরের তিনি একজন সাহিত্যযশপ্রার্থী নবীন কবি ও সাময়িক পত্রের সম্পাদক ছিলেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সে এক ভীষণ আন্দোলনমুখর অগ্নিগর্ভ সময় ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ওড়ে ওঠা বাঙালি জাতিসত্তা স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চ‚ড়ান্ত সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষা দিচ্ছিলো। মোহাম্মদ সোলায়মানের তরুণ বয়স,পশ্চিমা অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির রণদামামা বেজে উঠতে না উঠতেই সোলায়মানের রক্ত দ্রোহে প্রলয় নাচন নেচে উঠেছিলো। আগে থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন থেকে স্বদেশব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীনতার কবল থেকে মাতৃভূমিকে উদ্ধার করার জন্য তিনিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের সভা চলছিল। সংসদ কক্ষে একটি ছোট রেডিও ছিলো। ভিপি আনোয়ারুল আজিম হঠাৎ শুনলেন ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন। এই ঘোষণা সভাস্থলে এমন একটি ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো যে তারা সঙ্গে সঙ্গে সভা শেষ করে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ছাত্র-শিক্ষক-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে দক্ষিণে সরকারহাট, উত্তরে ফটিকছড়ি বিবিরহাট পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে। দু’তিন হাজার লোক নিয়ে শুরু হওয়া মিছিলটি শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার লোকের এক বিরাট গণমিছিলে পরিণত হয়েছিলো। ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিলো। মিছিলের পর রাতে নাজিরহাট কলেজ হোস্টেলের ১০নং রুমে সভা করে তারা সিদ্ধান্ত নেন ২ মার্চ দুপুর ২টা থেকে কলেজ মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া হবে। যথারীতি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দিতেন ফ্লাইট সার্জেন্ট দবিরুলআলম ও আনসার কমান্ডার আবদুস সাত্তার। প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৫০ জন থেকে সর্বোচ্চ ২০০ জন পর্যন্ত প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথে একদিকে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা ও অন্যদিকে আতংক পরিলক্ষিত হয়। একটি থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। চট্টগ্রাম কলেজের মাঠে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিলো; অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, এজাহরুল হক, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি জালাল উদ্দিন আহমদের সহযোগিতায় সেই নাটক নাজিরহাট কলেজে এনে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন আনোয়ারুল আজিম। তারাও এসেছিলেন। নাটক দেখার জন্য ৬০/৭০ হাজার লোক জমায়েত হয়েছিলো। ২৫ মার্চ সকালে আজিম, হাবিব, ইউনুস শহরে এসেছিলেন খবরাখবর নেয়ার জন্য। রাতে হেটে নাজিরহাট যাওয়ার সময় ১২টার পর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান। আনোয়ারুল আজিমের নেতৃত্বে নাজিরহাট সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ২৬ মার্চ সকাল থেকে নাজিরহাটে রিক্সা নিয়ে মাইকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে থাকেন এবং জনসাধারণকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান। শহরের পতনের পূর্ব পর্যন্ত শহরে যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং বাঙালি সৈনিকদের জন্য রসদ নিয়ে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পর সবাই নাজিরহাট গিয়ে আশ্রয় নেন। নাজিরহাট একটি ট্রানজিট ক্যাম্পের মত ছিলো। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত নাজিরহাট মুক্ত ছিলো।
নাজিরহাট উত্তর চট্টগ্রামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও সর্বশেষ ঘাঁটি। নসরত শাহের রাজধানী ফতেয়াবাদ (হাটহাজারী) ও ঈছাপুর পরগণার (ফটিকছড়ি) সঙ্গমস্থলে নাজিরহাটের অবস্থান। তার উত্তরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ভারতের সাথে যোগাযোগ করতে হয় নাজিরহাট ও রামগড় সড়ক হয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর নাজিরহাটে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং নাজিরহাট বাজারে ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাদশা আলমের দোকানের পেছনে সংগ্রাম কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়। ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের অফিসও ছিল ঐ দোকানে। নারায়ণহাট ও নানুপুর বাজারে ‘সংগ্রাম কমিটি’র আরো ২টি সাবসেন্টার খোলা হয়। প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রশাসনিক ব্যবস্থা হাতে নেন। তখন পাক বাহিনীর ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভয়ে মানুষ শহর হয়েভারতের উদ্দেশ্যে নাজিরহাটে ছুটে যাচ্ছিল। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ। সবাই আসছে পায়ে হেঁটে। নাজিরহাটে পৌঁছে তারা সাময়িক বিশ্রাম নিত। দূরদূরান্তের মানুষের জন্যে নাজিরহাটে সংগ্রাম কমিটিচারটি আশ্রয় শিবির খুলেছিল।শিবিরগুলোতে প্রায় ২০০০ লোকের থাকা, খাবার ব্যবস্থা করা হয়। আশ্রয় শিবিরের জন্যে খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। খোলা হয় দালাল, গুপ্তচর, পলাতক সৈনিকের জন্য জেলখানা। হাসপাতাল ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়। বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসন বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা হয়। এক একজন কর্মীকে এক একটি বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। খাদ্য বিভাগ ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। নাজিরহাট খাদ্যগুদাম ছিলোঅ্যাডভোকেট সোলায়মানেরনিয়ন্ত্রণে। খাদ্যগুদামে তাদের পক্ষের ২ জন পাহারাদার নিয়োগ করা হয়। লঙ্গরখানার দায়িত্বে দেওয়া হয় আকতার কামালের নেতৃত্বে ৫ জনকে। নাজিরহাট কলেজ মাঠ ও কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সংক্ষিপ্ত অস্ত্র চালনোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। চোর, ডাকাত, দালাল, গুপ্তচর ও পলাতক সৈনিকের জন্যে জেলখানা খোলা হয়। হাসপাতাল ও টেলিফোন ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হয়। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কিছু লোককে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন:
১। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে:(ক) ফ্লাইট সার্জেন্ট দবিরুল আলম (সোবহান মোল্লা বাড়ি), (খ) আনসার কমান্ডার আবদুস সাত্তার, ২। খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্বে:(ক) মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (মন্দাকিনী), (খ) মনির আহমদফরেস্টর (দৌলতপুর), ৩। অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্বে:(ক) আনোয়ারুল আজিম (ছাত্রনেতা ও ভিপি নাজিরহাট কলেজ), (খ) আতরজ্জামান মেম্বার (নাজিরহাট), ৪। টেলিফোনের দায়িত্বে:(ক) আবদুল হালিম (পশ্চিম ফরহাদাবাদ), (খ) আহমদহোসেন (মন্দাকিনী), ৫। জেলখানা ও চেক পোস্টের তত্ত¡াবধানে: মোহাম্মদ সোলায়মান (অ্যাডভোকেট, বাবুনগর), ৬। খাদ্য ও আশ্রয়ের দায়িত্বে:(ক) মোহাম্মদ ইউনুচ (নাজিরহাট), (খ) আমিরুল ইসলাম (ডাইনজুরী), ৭। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে:(ক) এম আবামিয়া মাস্টার (বাবুনগর)- সভাপতি, দৌলতপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, (খ) হাফেজ আহমদবি.কম (পূর্ব ফরহাদাবাদ), সহ-সভাপতি, দৌলতপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, ৮। খাদ্য গুদামের দায়িত্বে:(ক) মোহাম্মদ শফি (ইউসুফের বাড়ি), (খ) মোহাম্মদ মুছা (নাজিরহাট), ৯। দূরবর্তী স্থানে যোগাযোগে: আবু তৈয়ব (নাজিরহাট), ১০। লঙ্গরখানার দায়িত্বে:(ক) আকতার কামাল (বাবুনগর) সাধারণ সম্পাদক, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, (খ) খোরশেদ মিয়া (লেপতোশক প্রস্তুতকারক, নাজিরহাট), (গ) মীর আহমদ(সুয়াবিল), (ঘ) জাকারিয়া (সুয়াবিল), (ঙ) মমতাজউদ্দিন (কুমিল্লা), ছাত্রদের দিক নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন আনোয়ারুল আজিম। সব বিভাগের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ছিল এম বাদশা আলমের হাতে। সব কাজ তাঁর নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। বাদশা আলমের পক্ষে এসএম ফারুক, আনোয়ারুল আজিম ও অ্যাডভোকেট সোলায়মান প্রত্যেক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম দেখাশুনা ও তদারকি করতেন। সকলে মিলেমিশে সে সময় যেভাবে কাজ পরিচালনা করেছিলেন, তা প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। দালাল, গুপ্তচর, চোর-ডাকাতকে গ্রেফতার ও পলাতক সৈনিককে বন্দী করে জেলখানায় রাখা, আবার তাদেরকে সংগঠিত করে যুদ্ধে প্রেরণ করার দায়িত্বও অ্যাডভোকেট সোলায়মানের ওপর ন্যস্ত ছিলো। পশ্চিম ফরহাদাবাদ থেকে হাবিব, সেকান্দর, সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইউসুফ, মফজল আহমদ চৌধুরী, সুয়াবিল থেকে নুরুল ইসলাম তালুকদার, কাজী নুরুল ইসলাম, সুজাউদ্দৌলা, মোহাম্মদ ইসমাঈল, আহমদগনি, সোবহান মোল্লা বাড়ি থেকে অ্যাডভোকেট মো. লোকমান, আনোয়ারুল হক, সরকারহাট থেকে ফরিদ আহমদচৌধুরী, ভ‚জপুর থেকে আবুল কালাম আজাদ, দৌলতপুর থেকে রিজোয়ানী নুর চৌধুরী, গোলাম মাওলা, ফসিউদ্দৌলা, রোসাংগিরি থেকে আবু বক্কর মাস্টারসহ আরো অনেকে প্রতিরোধযুদ্ধে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা প্রদানকরেন।
এদিকে সংক্ষিপ্ত অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষাও দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছিলো। ফ্লাইট সার্জেন্ট দবিরুল আলম ও আনসার কমান্ডার আবদুস সাত্তারকে প্রশিক্ষণ পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। প্রথম অবস্থায় নেতৃবৃন্দ অস্ত্র পরিচালনা শিখে নেন। মার্চ ’৭১-এর প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনারা বেসামরিক পোশাক পরে নিরীহ জনগণের ওপর যেরূপ কমান্ডো হামলা চালিয়েছে সেরূপ নাজিরহাটে বেসামরিক পোশাকে কমান্ডো হামলা চালাতে পারে এ আশঙ্কা থেকে এসএম ফারুকের নেতৃত্বে নাজিরহাট ও তার আশেপাশের এলাকায় রাতে গোপনে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি দলে ১০ জন করে ৫টি দল সারারাত পাহারায় ব্যস্ত থাকে, যাতে ‘ছত্রীসেনা’ কমান্ডো হামলা প্রতিরোধ করা যায়।চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মজিবুর রহমানের কর্তৃত্বাধীনে রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘোষণা করলাম। স্বাধীন বাংলাদেশের নীতি হবে সকলের প্রতি বন্ধুত্ব। আমরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুনিয়ার সকল দেশের সাহায্য ও সমর্থন কামনা করছি।’ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এরূপ ঘোষণায় মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সাড়া জাগে।
অ্যাডভোকেট সোলায়মানের উদ্যোগে অস্ত্রের অভাব মোকাবেলার জন্যে একটি শক্তিশালী তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করা হয়। উদালিয়া, ফেনুয়া ও বারমাসিয়া চা বাগানের উপজাতীয় ত্রিপুরা (ধাঙ্গর নামে পরিচিত) শ্রমিকরা এই বাহিনীর যোদ্ধা। তারা ধনুক দিয়ে জীবজন্তু শিকারে পারদর্শী। নাজিরহাট ও নানুপুর বাজার থেকে কামার এনে তীর বানানো হয়। ধনুকগুলো ছিল তাদের নিজস্ব। রেল লাইনের লোহা দিয়ে তীরগুলো তৈরি হয়। বানানো তীরগুলোতে বিষ লাগানো হয় দ্রæত কার্যকারিতার জন্যে। প্রথমে ১০৫ জন তীরন্দাজ বাহিনীর মধ্যে ৪০ জন চন্দ্রনাথে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নেয়। বাকি বাহিনী উদালিয়া চা বাগান, সুয়াবিল, ও সুভনছড়ি পাহাড়ী এলাকায় নিয়োজিত থাকে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে বোমা হামলা করতে না পারে সেজন্যে নাজিরহাট ঘাঁটি ও তার আশেপাশের এলাকায় নিষ্প্রদীপ (ব্ল্যাক আউট) রাখা হয়। ফলে নাজিরহাট বাজার ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। চারদিকে নিস্তব্ধ ঘনঅন্ধকার। রাতে ছিলো কারফিউ। সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে বাজার এলাকা হয়ে যেত জনমানবশূন্য। এর মধ্যে কিছু সংগ্রামী যুবক রাতদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শহর থেকে দিশেহারা হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নাজিরহাটের আশ্রয় শিবিরে। থাকা ও খাওয়াসহ একসাথে অনেক শরণার্থী আশ্রয় শিবিরে স্থান পায়। একরাত আশ্রয়ে থেকে পরদিন ভোরে তারা আবার ছুটে চলে সীমান্তের উদ্দেশ্যে অচেনা-অজানা পথে। নাজিরহাট আশ্রয় শিবির থেকে যতটুকু সম্ভব তাদের যাত্রাপথে টাকা দিয়ে, খাবার দিয়ে সাহায্য করা হয়। বাড়িঘর ছেড়ে অশ্রু আর বুকভরা ব্যথা নিয়ে তাদের যাত্রা। তারা শুধু হেঁটেই যাচ্ছে মাইলের পর মাইল।
পেছনের কথা : ষাটের দশক থেকে আন্দরকিল্লা ও নজির আহমদ চৌধুরী রোডকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহরে সাহিত্যের পুষ্প প্রস্ফুটিত হতে থাকে এবং ’৬৯-’৭০-এ সাহিত্য ও সংবাদপত্রের গোলাপ বাগান হয়ে ওঠে। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান সেই সময়ের একজন সাহিত্যকর্মী ও সাময়িক পত্রের সম্পাদক। বিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৯০৪) চট্টগ্রাম পৌরসভা লালদিঘী বাকল্যান্ড ঘাট থেকে আন্দরকিল্লায় স্থানান্তরিত হয়ে আসার পর আরাকানী মগদের কিল্লাটি যখন একদিকে নবী স্টোরস এবং অন্যদিকে নানা পণ্যের শোভা নিয়ে কোরবান আলী সওদাগরের বিপণিটি ঝলমল করে ওঠে, তখন একে একে গ্রন্থ বিপণিরও সমারোহ ঘটতে থাকে। সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের আস্তানা গড়ে উঠেছিল আরও কিছু আগে। লালদীঘির উত্তর প্রান্তে আন্দরকিল্লা সড়ক যেখান থেকে শুরু হয়েছে, নবী স্টোরসের প্রায় বিপরীতে হাসান মঞ্জিল থেকে খান বাহাদুর আমান আলী প্রকাশ করেছিলেন অর্ধ সাপ্তাহিক ‘সুনীতি’। ডা. এম এ হাশেম, ডা. মোহাম্মদ ওমর এবং ডা. মোহাম্মদ আবদুল জব্বার-চট্টগ্রামের প্রথম এমবি পাস এই ডাক্তার ত্রয়ীর অন্যতম ডা. ওমর ‘সত্যবার্তা’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন তাও আন্দরকিল্লা থেকে। চিটাগাং ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ‘কোহিনূর’; তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক আজাদী’ও প্রকাশ করেন। দু’টিরই জন্মস্থান আন্দরকিল্লা।
ব্রিটিশ আমলে পটিয়া থানা নিবাসী খন্দকার মনির আহমদ আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী রোডের মুখে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ নামে একটি গ্রন্থ বিপণির পত্তন ঘটালে সেটি চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডা ও যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কবি ওহীদুল আলমের বিখ্যাত ‘পূরবী’ পত্রিকা প্রকাশিত হত ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে। সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম, আবুল ফজল, গবেষক ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক আশুতোষ চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ অন্নদাশংকর রায় প্রমুখের আনাগোনায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি চট্টগ্রামের প্রধান সাহিত্যতীর্থ হয়ে উঠেছিল। অন্নদাশংকর রায় তখন চট্টগ্রামের এডিএম বা বর্তমানের এডিসি ছিলেন। একই গলির কিছুটা দক্ষিণে চেয়ারম্যান ফজল করিমের গলির মুখে আবদুর রহিম চৌধুরীও একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেছিলেন, যার নাম ছিল নূরজাহান লাইব্রেরি। সুবিখ্যাত তাজ লাইব্রেরির সঙ্গে একসময় সাহিত্যিক আবুল ফজলও জড়িত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ৩০, নজির আহমদ চৌধুরী রোডে ইউনাইটেড লাইব্রেরি নামে অপর একটি লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে আরও একটি সাহিত্য আড্ডা সৃষ্টি হয়েছিল, যেটি দীর্ঘদিন সৌরভ ছড়িয়েছিল। এই আড্ডার কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হলেনÑ আলাদীন আলীনূর, নূর মুহাম্মদ চৌধুরী সাহিত্যরতœ, ড. কাজী নাসির উদ্দিন, অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন, ড. খালেদ মাসুকে রসুল, অমিতাভ বড়–য়া, জহুর উশ শহীদ, আবদুস সালাম খান, আবদুল মাবুদ খান, ডা. কাজী মোহাম্মদ ইউসুফ, সাংবাদিক মোহাম্মদ মোসলেম খান, মৃণাল বড়–য়া, খন্দকার আখতার আহমদ, নাসিমা খান মিলি, মুজিবুর রহমান কায়েস, সামশুল হক হায়দরী, অধ্যাপক আনন্দ মোহন রক্ষিত, খালিদ আহসান এবং আরো অনেকে। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান এই সাহিত্য আড্ডারই সতীর্থ ছিলেন। তিনি ‘আমরা’ নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন। তিনি প্রথম জীবনে সরকারি চাকরি করতেন, সেই চাকরি করতে করতে লেখাপড়াও চালিয়ে যান। এই সময় আগরতলা মামলা বাতিল ও রাজবন্দীদের মুক্তি, ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে দেশে প্রচন্ড আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। মোহাম্মদ সোলায়মান আগে থেকেই ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে ছাত্ররাজনীতির মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। ৬৮-৬৯-এর উপর্যুক্ত আন্দোলনে তিনি অগ্নিমশাল হয়ে রাজপথে জ্বলে উঠেন। শহরে তিনি থাকতেন আন্দরকিল্লা ও রহমতগঞ্জে। তার বিচরণ ক্ষেত্র ছিল আন্দরকিল্লা। আর তখন শহরের রাজনীতির কেন্দ্রও ছিল আন্দরকিল্লা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অফিস আন্দরকিল্লা, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের অফিস নজির আহমদ চৌধুরী রোডে। তিনি পড়াশোনা করতেন ল কলেজে। এই রাজনীতি ও আন্দোলনমুখর স্থানে অবস্থান করে অ্যাডভোকেট সোলায়মানের পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব ছিল না। তখন দেশে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি দানা বেঁধে উঠছিল, মোহাম্মদ সোলায়মান সেই রাজনীতিরই একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে তার এলাকা ফটিকছড়িতে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে যখন জননেতা বাদশা আলমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম থানা কমিটি গঠিত হচ্ছিল, সেখানেও জনাব সোলায়মান উদ্যোগী ভূমিকায় জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যকরী কমিটির কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান ২৬ মে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর ইউনিয়নের বাবুনগরে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত পিতা হামিদুর রহমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মাতা জরিফা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। ছোটভাই মো. ওসমান গণি ও মোহাম্মদ লোকমান আমেরিকা প্রবাসী। ছোটবোন মাহমুদা খাতুন।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ সোলায়মান এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন এবং রাজনীতিও অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম এমইএস কলেজে (নৈশ বিভাগ) স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এসময় তিনি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমইএস কলেজের দিবা শাখা চালু করতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। যুদ্ধকালে সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তে দেশে থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৭৩- ৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আইন সনদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মোহাম্মদ সোলায়মান ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক আজাদীর ‘আগামীদের আসর’-এর ৩৮৭ নম্বর সদস্য হয়ে লেখালেখি করেন। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় তাঁর শতাধিক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-৭৭ পর্যন্ত তিনি ‘চট্টগ্রাম লেখক সংঘে’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এখন অবসরেও তিনি লিখে যাচ্ছেন। “উত্তর চট্টগ্রাম : প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ” শিরোনামে তাঁর রচিত একটি গ্রন্থ ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান হাসিনা বেগমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি এক পুত্র ও দু’কন্যা সন্তানের জনক। পুত্র-সাদেক রহমান কাকন ও পুত্রবধূ উম্মে ওয়ারা জেরিন, দুকন্যা নিশাত সুলতানা নিসু ও তানিয়া সুলতানা ডানা।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক