নাকের বদলে নরুন পাওয়া শেয়ালের আনন্দ

1

সুরেশ কুমার দাশ

এক ক্ষুধার্ত শেয়াল বেগুন ক্ষেতে বেগুন খেতে গিয়ে তার নাকে বেগুনের কাঁটা বিঁধেছিল। শেয়াল নাপিতের কাছে গিয়েছিল কাঁটা তুলতে। কিন্তু শেয়ালের যাই হোক, নাপিতের কাছ থেকে সে নরুন নিয়ে এসেছিল। অথচ এর আগে তার কতটা গেছে সে তা হিসাব করতে পারে নাই। তবু নরুন পেয়ে শেয়ালের আনন্দ আর ধরে না।
কবি জসীম উদ্দিনের ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ গ্রন্থের ‘নাকের বদলে নরুন পাইলাম’ গল্পটা একটু পড়ে ফেলা যাক। নাপিতের কাছ থেকে নরুন পেয়ে খুশিতে ডগমগ শেয়াল এ পাড়া ও পাড়ার হয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে পাশেই কুমার পাড়ার এক কুমারের সাথে দেখা। শেয়ালকে দেখেই কুমার বলে উঠল-
‘শেয়াল মামা শেয়াল মামা! /মুখে ওটা কি/ একটুখানি দাঁড়াও দেখি/ পরখ করে নি।’
শেয়াল দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওটা নরুন, নাকের বদলে পেয়েছি।’ কুমার শেয়ালের নরুনটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে, উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে হঠাৎ হাত থেকে মাটিতে পড়ে নরুন ভেঙ্গে গেল। এরপর শিয়াল তো রেগেমেগে সয়লাব। বলল, ‘এক্ষুণি নরুন জোড়া লাগিয়ে দে। না হলে এক্ষুণি তোর সব হাঁড়িপাতিল ভেঙ্গে চুরমার করে দেব।’
নাপিত বলল, ‘মামা গ্রামে কোনো কামার নেই। কেমনে ভাঙ্গা নরুন জোড়া দেব? তখন শেয়াল বলল, ‘ তাহলে নরুনের বদলে একটি হাঁড়ি দে। তাহলে নরুন ভাঙ্গার শাস্তি মাফ।’ কুমার রক্ষা পেল। শেয়ালকে একটা হাঁড়ি দিয়ে। এবার শেয়াল মামা মুখে হাঁড়ি নিয়ে গ্রাম পর গ্রামে ছুটতে লাগল। রাত নেমে আসল, অনেক রাত। শেয়াল দেখল বিলের মাঝ দিয়ে একদল বরযাত্রী উৎসব-আনন্দ সহযোগে বর-কনে নিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে ঘটে গেল এক বিপত্তি। উৎসব-আনন্দের পটকাবাজির ছোটে শেয়ালের হাঁড়ি গেল ভেঙ্গে। শেয়াল তো রেগে অস্থির। বরযাত্রীর পথরোধ করল।
বলল, ‘আমার হাঁড়ি ভেঙ্গেছ। জোড়া দিয়ে যাও। নইলে তোমাদের পাড়ায় গিয়ে সকল হাঁস মুরগি খেয়ে ফেলব।’ হুমকিতে বরযাত্রী বহরের পালকি থেকে নেমে আসল বর। শেয়ালের কাছে মাফ চাইল স্বয়ং বর। কিন্তু এমনি এমনি মাফ করতে রাজি নয় শেয়াল। একদম হাঁড়ির বদলে বরের কাছে চেয়ে বসল তার সদ্য পরিণীতাকে। বর তাকে দিতে যাবে কেন? কিন্তু ওই নতুন বউ ছাড়া আর কিছু চায় না শেয়াল। বউটাই তার চায়। গত্যন্তর না দেখে বরযাত্রীরা বরকে ধরল- কনেকে দিয়ে দাও শেয়ালের কাছে। না হলে আমাদের ক্ষেত-খামার, হাঁসমুরগি খেয়ে ফেলবে।
আর কী করা! কনে দিতে বাধ্য হল শেয়ালকে। কনে পেয়ে আরো খুশি হল শেয়াল। এবার সে বিয়ে করবে। বাদ্যবাজনা সহকারে। গেল ঢুলির বাড়ি। ঢুলিকে বলল- তার বিয়েতে বাদ্যবাজনা চাই। সেই ব্যবস্থা করতে।
ঢুলি বলল, ‘আমার দলের সবাইকে খবর দিতে হবে। শুধু ঢোল দিয়ে চলবে না। ঢোল-ডাগর কাড়া-নাকাড়া, সানাই বাজাতে হবে।’ ঢুলি গেল দলের সবাইকে ডাকতে। বিয়ের যোজনা করতে ব্রাহ্মণ লাগবে। শেয়াল গেল ব্রাহ্মণ ডাকতে। কনেকে রেখে গেল ঢুলির বউয়ের হেফাজতে। ঢুলির বউ কুটনা কুটতে বসেছে। পাশে নতুন কনে বসে ঝিমুনি দিচ্ছে। ঝিমুনি দিতে দিতে ঢুলির বউয়ের বটির উপর পড়ে কেটে চৌচির হয়ে মারা গেল বউ। ঢুলির বউ তাকে খড়ের গাঁদায় লুকিয়ে রাখল। এরপর শেয়াল এসে দেখে কনে নাই।
ঢুলির বউকে বলল, ‘আমার কনে এনে দাও।’ ঢুলির বউ কেঁদেকেটে মাফ চাইল। শেয়াল মাফ করবে- শর্ত একটি ঢোল তাকে দিতে হবে। তাতে রক্ষা পেল ঢুলির বউ। এবার ঢোল পেয়ে শেয়াল সেটি গলায় ঝুলিয়ে তালগাছের মাথায় উঠে বাজিয়ে গান গাইতে লাগল। গান গাইতে গাইতে তালগাছের মাথা থেকে পড়ে শেয়াল না ফেরার দেশে চলে গেল।
শেয়াল কেন নাপিতের কাছ থেকে নরুন পেয়েছিল? শেয়ালের নাক থেকে বেগুন কাঁটা তুলতে গিয়ে নাপিত শেয়ালের নাক কেটে ফেলেছিল। এর বদলা বাবদ নাপিতের কাছ থেকে নরুন পেয়েছিল শেয়াল। এই নরুন পেয়েই ছুটতে শুরু করে শেয়াল। কিন্তু কিসের আশায় ছুটেছিল সে?
শেয়ালের মত একের পর এক ছুটতে থাকা জনগণও কিসের আশায় ছুটছে? কার কাছে যাবে, তারা জানে না। শেষ পর্যন্ত যারা নিজেরাই নিজের গজব ঢেকে আনছে শেয়ালের মত। কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত থেকে জনগণের যে সামগ্রিক মুক্তির লক্ষ ছিল তার অন্যতম কারণ ছিল দ্রব্যমূল্যের নামে লুটপাট থেকে রেহাই পাওয়াও। কিন্তু সবকিছু নিজের মত মনে করেছিল বলেই স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। অসহনীয় পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে যে আওয়ামী লীগ তথাকথিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার। কিন্তু ক্ষমতায় এসে জনগণের দ্রব্যমূল্যের সঙ্কট সমাধানের প্রতিশ্রুতিকে হাসিতামাশার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। জনগণের এরকম ব্যাপক ক্ষোভই স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারকে বাধ্য করেছে দেশ ছাড়তে। অথচ নতুন সরকার দেশ চালালেও জনগণের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে বাজারের যে চাপ তার কোনো পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়িয়ে এবং
জনগণের টাকা পাচার, চাঁদাবাজি ও লুটপাট করে যে দায়দেনা তা জনগণকে শোধ করতে হচ্ছে। অথচ পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের জন্য প্রত্যক্ষ সুবিধা সৃষ্টি করা, সরকারের সেই সহযোগিতা ভোক্তারা ছিটেফোঁটাও পায়নি। যাতে ভোক্তারা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আজ এটা নয় তো কাল আরো কয়েকটা পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কেজিতে চার-পাঁচ টাকা করে বেড়েছে চালের দাম- সেই খবর আমরা পত্রপত্রিকায় পেয়েছি। গত ডিসেম্বর মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই দুটি হার দুই অঙ্কের ঘরে থাকার মানে হল- সংসার চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে।
বাজারের এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার শতাধিক পণ্য ও সেবায় অন্তত ১৫ শতাংশ ভ্যাট চাপিয়ে দিয়েছে যাকে অযৌক্তিক বলছেন অংশীজনরা।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় করে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে জনগণ সেই সরকারের কাছে জনগণের যে ব্যাপক আশা আকাক্সক্ষা ছিল তার অন্যতম হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে মূল্যকে যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে আসা। বর্তমান সরকার এজন্য জনগণকে বার বার আশ্বস্থ করে এসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বশীল নানা জায়গা থেকে প্রচেষ্টার কথা শুনা গেছে। শেষ পর্যন্ত জনগণের আশায় গুঁড়েবালি। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে বস্তুত স্বস্তিদায়ক কোনো সক্ষমতা দেখাতে না পারলেও ভ্যাট বাড়ানোর পদক্ষেপ ভোক্তা এবং অংশীজনদের জন্য কাক্সিক্ষত ছিল না। ভোক্তারা আশা করেছিল দ্রব্যমূল্যের নামে লুটপাট চালিয়ে যারা জনগণের উপর চেপে বসেছে তাদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন সরকার জনগণকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় বাড়াতে।
এসবের মধ্যে জনগণও বুঝতে পারছে না, কোনটায় তার লাভ। নরুনে লাভ নাকি হাঁড়িতে লাভ, নাকি বরের কনেতে, নাকি ঢোল বাজানোতে। অথচ শেষ পর্যন্ত ঢোল বাজাতে গিয়েই ক্ষুধার্ত শেয়ালটা অক্কা পেয়েছিল। আর ধূর্ত শেয়ালজাতটাকে বাঙালি কেমন বোকা বানিয়ে এমন গল্প ফেঁদে বসল, যেখানে নিজের বোকামিকে আড়ালে রেখেছে। যখন তার পকেট ও পেটের খবর কারো দায়িত্বে পড়ে না। বাঙালি আসলে এমনই- যে কথা সলিল চৌধুরী তার গানে বলেছেন- ‘আমার বাবাও বোকা ছিল, আমি তো তার ছেলে’ যারা আজও দাবা বোডের চাল বোঝেনা।
লেখক : সাংবাদিক