নবুয়ত ও নবীগণ

9

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

ইসলামি জীবনদর্শনে নবুয়ত এক অপরিহার্য বিষয়। আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়াকে নবুয়ত এবং পৌছে দেওয়ার দায়িত্বকে রিসালাত বলা হয় । যা কেবল নবী-রাসুলগণের কাজ। কেননা, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নবীগণের সহযোগিতা ও পথপ্রদর্শন ছাড়াও বিশ্ব গ্রষ্টার অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পারে বটে, কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বের সাথে তাঁর মৌলিক গুণাবলীর সঠিক পরিচিতি, তাঁর পবিত্রতা, নিষ্কলুষতা, ইত্যাদি বিষয়ে অবগত হওয়া নবী-রাসূলগণের সহযোগিতা ব্যতিরেকে আদৌ সম্ভব নয়। আর নবীগণ সংবাদ দেন এবং রাসূলগণ সকল আহকাম কাক্ষিত স্তর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন। সকল নবী ও রাসূল উম্মতের নিকট আল্লাহ তায়ালার সংবাদবাহক ও দীনের প্রচারক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ২১৩ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই দীনের অনুসারী ছিল। তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল তখন) আল্লাহ নবী পাঠালেন, (সত্যপন্থীদের জন্য) সুসংবাদদাতা ও (মিথ্যাশ্রয়ীদের জন্য) ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে। আর তাদের সাথে সত্যসম্বলিত কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তা মানুষের মধ্যে সেই সব বিষয়ে মীমাংসা করে দেয়, যা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল।’
নবী-রাসূলের বৈশিষ্ট্য: নবী ও রাসুলগণ পূর্ণ জ্ঞান ও সুস্থ স্বভাব, সত্যবাদিতা, আমানতদারীতা প্রভৃতি গুনে গুণান্বিত ছিলেন এবং মানবিক সকল ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁদেরকে পবিত্র ও সম্মানিত করেছেন। তাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের সকল গুনাবলী দান করেছেন। তিনি তাদের মাঝে দান করেছেন ধৈর্য্, জ্ঞান, উদারতা, সম্মান, দানশীলতা, বীরত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা। যাতে এসব আখলাকের কারণে তারা নিজ জাতির কাছে আলাদা বৈশিষ্ট্যে পরিচিত হন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ এমন কোন নবীকে পাঠাননি যে তার চেহারা সুন্দর ছিল এবং তার কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর এবং তোমাদের নবী তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চেহারা ও কণ্ঠস্বরের অধিকারী।’ রাসুলগণ হলেন আল্লাহ তায়ালার সর্বোত্তম সৃষ্টি, তিনি তাদেরকে নির্বাচিত করেছেন তাঁর রিসালাত ও আমানত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। তাঁদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা ও বিশ্বাস হল, রাসূল ও নবীগণ এই পৃথিবীতে ওহী লাভ করার পূর্বেও রাসূল ও নবী। অনুরূপভাবে পৃথিবীর জীবন সমাপ্তি লাভের পরও। তারা সদা-সর্বদা মাসুম বা নিষ্পাপ।
নবী রাসূলের সংখ্যা :
পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। হাদীসের ভাষ্য মতে নবী-রাসূলের সংখ্যা লক্ষাধিক।তাঁদের ভেতর ২৬ জনের নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ১৮ জনের নাম সূরা আনআমের ৮৩ থেকে ৮৬ নম্বর আয়াতে একত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং বাকিদের নাম অন্যত্র এসেছে। প্রথম মানুষ আদম (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাক্রম শুরু হয় এবং মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাধ্যমে তা শেষ হয়। ঐতিহাসিকরা কুরআনুল করিমে বর্ণিত নবী-রাসুলদের আগমনের একটি ধারাক্রম বর্ণনা করেন। যথা-১.আদম (আ.) ২.শিশ ইবনে আদম (আ.)৩.ইদরিস (আ.) ৪.নুহ (আ.) ৫.হুদ (আ.) ৬. সালেহ (আ.) ৭.ইবরাহিম (আ.)৮.শোয়াইব (আ.)৯.ইসমাঈল (আ.)১০.ইসহাক (আ.)১১.ইয়াকুব (আ.), ১২.ইউসুফ (আ.), ১৩.আইয়ুব (আ.), ১৪.জুলকিফল (আ.), ১৫.ইউনুস (আ.), ১৬.মুসা (আ.), ১৭.হারুন (আ.),১৮. খিজির (আ.), ১৯.ইউশা ইবনে নুন (আ.), ২০.ইলিয়াস (আ.), ২১.দাউদ (আ.), ২২.সোলাইমান (আ.), ২৩.জাকারিয়া (আ.), ২৪.ইয়াহইয়া (আ.) ২৫. ঈসা (আ.) ২৬. মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুসলিম মাত্রই নাম জানা ও অজানা সব নবী ও রাসুলকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
কখন থেকে নবী ?
নবীগণ রূহের জগতেও নবী হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। এ জন্যে মহান আল্লাহ নবীগণকে নিয়ে পৃথক মজলিস সাজিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ৮১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-‘আর (হে হাবিব!) স্মরণ করুন! সে সময়ের কথা, যখন আল্লাহ্ নবীগণের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, ‘যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করবো, অতঃপর তোমাদের নিকট আগমন করবেন (সর্বোপরি মহত্তের অধিকারী) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যিনি সত্যায়ন করবেন সেসব কিতাব যা তোমাদের কাছে থাকবে; তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে এবং অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করে নিলে এবং (এ শর্তে) আমার অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করলে’? সবাই (নবীগণ) বললেন, ‘আমরা স্বীকার করে নিলাম’। তিনি বললেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম’।
উপর্যুক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, শুধু আমাদের নবী নয়; সকল নবীগণই পৃথিবীতে আগমণের পূর্বে আলমে মিছাক-এ নবীই ছিলেন। হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিসসালাম প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ৩৯ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘যখন যাকারিয়া ইবাদাত কক্ষে নামাযে দন্ডায়মান তখন ফেরেশতারা তাকে সম্বোধন করে বলল: আল্লাহ তোমাকে ইয়াহ্ইয়া’র সুসংবাদ দিচ্ছেন, সে হবে আল্লাহর পক্ষ হতে আগত কালেমার সত্যতার সাক্ষ্যদাতা, সরদার (দল প্রদান), গুনাহ হতে বিরত ও নেক বান্দাগণের মধ্য হতে একজন নবী।’ হযরত ইসা আলাইহিসসালাম এর ব্যাপারে কুরআনুল কারিমের সূরা মরিয়মের ৩০নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে -‘অমনি শিশুটি বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন।’ রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের নবুয়তের ব্যাপারে ইরশাদ করেন, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টিতে ছিলাম নবীগণের সর্বপ্রথম ও প্রেরণে ছিলাম নবীগণের সর্বশেষ।’ (এই হাদীসটি আল্লামা কাযী আয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর শিফা শরীফে অন্য সনদে বর্ণনা করেছেন। ইমাম সূয়ূতী উক্ত হাদীসটি সংকলন করে বলেন যে, হাদীসটি সহিহ বা শুদ্ধ।) অন্যত্র বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল ! আপনার উপর কখন নবুয়্যতের দায়িত্বারোপ করা হয়েছে? নবীজি ইরশাদ করলেন, যখন আদম আলাইহিস সালাম শরীর ও রুহের মধ্যবর্তী স্তরে ছিলেন। (অর্থাৎ যখন আদম আলাইহিস সালামের রুহ ও শরীরের মধ্যে কোন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি, আমি তখনও নবী ছিলাম)। (জামে তিরমিজি , ৫/৫৮৫, হাদীস:৩২০৯)
সুতরাং ৪০ বছর বয়সে নবীগণ নবুয়ত লাভ করেন না, বরং নবুয়ত প্রকাশিত হয়। অতএব, চল্লিশ বছর বয়সে নবীগণের নবুয়ত লাভ করেন- এ আকিদা-বিশ্বাস সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। যারা মিডিয়ায় কিংবা লিখনীর মাধ্যমে অপপ্রচার চালায় যে, “নবীগণ চল্লিশ বছর পরে নবী হয়েছেন; ইতিপূর্বে তারা জানতেন না যে, এক সময় নবী হবেন”, তারা মূলত মুসলিম বেশে বিধর্মীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম মিল্লাতকে তাদের থেকে হিফাজত করুক, আমিন বিজাহিন নবিয়িল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

লেখক : আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ দরসে নিযামী মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম