স্বৈরাচার আমলে সরকার যে কায়দায় বিভিন্ন পণ্যের উপর নতুন শুল্ক-কর বাড়িয়ে দিত একই কায়দায় অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু পণ্যের ভ্যাট বাড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত যার প্রভাব পড়বে বাজারে, ভোক্তাভোগি হবে সাধারণ জনগণ। সুতরাং নতুন শুল্ক-কর প্রত্যাহার করতে হবে। যেকোন বাজারপণ্যের উপর কর বাড়ালে তাতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। জনগণকেই তার মাসুল গুনতে হয়। দাতা সংস্থার কথায় জনগণের কথা বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত নেয়া অযৌক্তিক।
এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট, এখন এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আবার নতুন করে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে; কখনো খাদ্যে, কখনো খাদ্য বহির্ভূত খাতে, কখনো আবার সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে দুই অংকের ঘর। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইলে ফোনের সিম কার্ডের মত প্রয়োজনীয় পণ্যসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক ও কর বাড়ল। দেশের জনগণ এই সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলছেন। সরকার রাজস্ব বাড়াতে চায়, ভালো কথা। কিন্তু সেটা বাজেটে করা যেত। এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট। এখন এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আবার নতুন করে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি। তাই অধ্যাদেশ জারি করে শুল্ক-কর বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বৃহস্পতিবার রাতে ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ এবং ‘দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামে এ দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তার আগে ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে এনবিআরের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অধ্যাদেশ জারির পরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে; এতে তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর দাবি করেছে, এতে ভোক্তার বাড়তি মূল্য গুনতে হবে না। শুল্ক-কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছিলেন, এ পদক্ষেপে নিত্যপণ্যের বাজারে ‘প্রভাব পড়বে না’। কর আদায়কারী সংস্থা এনবিআরও একই সুরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দাবি করেছিল, মূল্যস্ফীতিতে ‘প্রভাব পড়বে না’। তবে, এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে। ‘সে কারণে’ অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ শুল্ক ও করের বোঝা বাড়ানোর পথে হাঁটে সরকার।
পণ্য ও সেবার তালিকায় চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেলের মত পণ্য না থাকলেও যেসব পণ্য ও সেবার শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগ বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় হওয়ায় তা খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে বলে মনে করছেন রাজনীতিকরা। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে আগের মাসের তুলনায় কিছুটা কমে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়াল, সানগøাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড সম্বলিত তৈরি পোশাকের শো-রুম বা বিপণি বিতানে পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল। বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডক ইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় পণ্য যোগানদাতা, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলা বিষয়ক ক্লাবে সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানি করা সুপারিতে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, পাইন বাদাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, তাজা বা শুকনা সুপারি ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙ্গুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, পেইন্টস, পলিমার, ভার্নিশ ও লেকার, সাবান ও সাবান জাতীয় পণ্য, ডিটারজেন্ট, ফ্রুট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আইএসপির উপর প্রথমবারের মত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। পটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিন প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ব্যবহারের অযোগ্য ট্রান্সফরমার অয়েল, লুবব্লেয়িং অয়েল, এলপি গ্যাস, বাল্ক ইম্পোটেড পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেওয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচ আর কয়েল থেকে সি আর কয়েল, সি আর কয়েল থেকে জিপি শিট, জি আই ওয়্যার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া হতে তৈরি ম্যাট্রেস- এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ, ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। তবে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে। প্রভাব পড়বে সমগ্র বাজারে। সংকটে পড়বে জনগণ। তাই নতুন শুল্ককর প্রত্যাহার জরুরি মনে করে দেশের সাধারণ মানুষ।