নতুন বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রসঙ্গে

2

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা উঠেছে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৬ ক্যাটাগরিতে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। সংস্কারের পরে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ দেশের পুরোনো এবং বড় দল হলেও ব্যাপক জনরোষ ও গণঅভ্যুত্থানে দলের নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ায় নেতাকর্মীদের মনোবল অনেকটা ভেংগে পড়েছে বলা যায়। মামলা, মোকদ্দমার খড়গ শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ প্রায় সব নেতার উপর। তাছাড়া, অনেক নেতা গ্রেফতার এবং কর্মীদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে শংকায় পড়েছে দলটি। ঘুরে দাঁড়ানো কিংবা আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া খুবই কঠিন হবে তাদের জন্য। বিশেষ করে বিদ্যমান নেতৃত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন দলের বহু নেতাকর্মী। দুর্নীতিবাজ ও মামলার জালে ফেঁসে যাওয়াদের পুরোপুরি বাদ রেখে একেবারে নতুনভাবে দল গোছাতে না পারলে ঘুরে দাঁড়ানো একপ্রকার কঠিনই হবে বৈকি! বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাÐের দায় কোনভাবেই এড়াতে পারবেনা দলটি – মনে করেন অনেকে। ফলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংস্কার তথা পরিবর্তন, শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন কমিটি করা এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত, নিহতদের ব্যাপারে ক্ষমা চাওয়া, দায়ীদের শাস্তি অথবা এই ইস্যুতে দলটিই বা কী করবে, ভূমিকা কী হবে তার পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে জনগণকে। কোনসময় আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হলে ফ্যাসিবাদী মনোভাব পরিহারের শতভাগ প্রতিশ্রুতিও কিন্তু দিতে হবে। তবে এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে প্রধান কাজ হবে অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনা করা এবং কেন, কি কারণে কিংবা কাদের জন্য দল ও সরকারের এমন ন্যাক্কারজনক পতন হয়েছে তা খুঁজে বের করা। সরকার পতনের পরপরই কেন দলের সবাই এভাবে আড়ালে চলে গেল বলা মুশকিল! এখন আওয়ামী লীগকেই মূলত ঠিক করতে হবে কী করবে তারা!
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ব্যাপক নিপীড়ন ও হামলা, মামলা, জেল-জরিমানাসহ নানা বাধার সম্মূখীন হয়েছে। তাদের অনেক নেতাকর্মীকে গুম, খুনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আরো নানা কিসিমের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। জামায়াত-শিবির তো একপ্রকার অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। বন্ধ করে দেওয়া হয় তাদের সব অফিস। এমনকি শেষ মুহুর্তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে জামায়াত, শিবিরকে নিষিদ্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। যা অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। এরপরও ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। পরে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার জামায়াত-শিবির এর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
বর্তমান বিদ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি, জামায়াত ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে তাদেরকেও। আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। দলের সব পর্যায়ে নেতৃত্ব ঠিক করতে ভোটাভুটির প্রচলন করতে হবে। পরিবারতন্ত্রের পথে না হেঁটে সৎ, নির্লোভ ও সাহসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে। সব ধরণের ফ্যাসিজমের বিলোপ সাধন করতে হবে। দলের তৃণমূল পর্যায়ে যদিও নজর দেওয়া কঠিন সেহেতু অন্যায়, অনিয়মের প্রমাণ মিললে তাৎক্ষণিকভাবে দলীয় ব্যবস্থা প্রয়োজনে অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে, ছাড় দেওয়া যাবেনা কোনভাবে। ক্ষমতায় গেলে সরকারের মন্ত্রী বা সরকারি অন্য কোন দায়িত্বে থাকলে দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ না করার মানসিকতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। নেতাকর্মীদের মাঝে সততা ও ন্যায়ের গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। দলীয় গঠনতন্ত্রকে দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা, ধর্মীয় ও নৈতিকতার বিষয়ে ধারা সংযুক্তসহ যুগোপযোগী করতে হবে। দেশের সাধারন মানুষের চাওয়া, পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। যদিও জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে। বিগত সরকারের দুর্নীতি, হত্যাকান্ডের পরোক্ষ সহযোগী তারাও, বলছেন সাধারন মানুষ। সব রাজনৈতিক দলকে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দলে বা সরকারে কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাবেনা, শাস্তি পেতেই হবে- এমন ধারণা তৈরি করতে হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের ব্যাপারে কোন রকম সহানুভূতি দেখানো যাবেনা বা আপোস করার কোন সুযোগ রাখা যাবেনা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, নিরপেক্ষ নির্বাচনে সকলের নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রদানসহ সব অধিকার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি দিতে হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি যেন আর কখনো না হয়।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্ত সাধারন মানুষ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তার ও প্রতিপক্ষ কিংবা সাধারন ছাত্রদের প্রতি অন্যায় আচরণ তাদেরকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন চালানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের সময় ছাত্রহত্যার সাথে তারাও জড়িত ছিল বলে দাবি ছাত্রদের। এসবের কারণে ছাত্রলীগের ব্যাপারে মানুষের মাঝে খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ এর শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি নেগেটিভ বার্তা গেছে যা ছাত্রসংগঠনটির জন্য সুখকর নয়। এ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে মানুষের সামনে আসার কোন পথ খোলা আছে কিনা কেউ বলতে পারেনা। এজন্য ছাত্রসংগঠনটিকে আগের সব নেতৃত্বের পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। গঠনতন্ত্রে আনতে হবে ব্যাপক পরিবর্তন। অপরাধের সাথে জড়িতদের দলীয়ভাবে শেল্টার দেওযা বন্ধ ও আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে প্রয়োজনে ক্ষমা চাওয়া ও দায়ীদের ছাড় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির দীর্ঘসময় সরকারের বাধার কারণে কোনঠাসা ছিল। ছাত্রসংগঠন দুটি এখন স্বাভাবিক কর্মকান্ড চালাতে পারছে। এরপরও সংস্কারের পথে এগোতে হবে তাদেরকেও। শিক্ষার্থীদের চাওয়া, পাওয়কে গুরুত্ব দিয়ে গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। কোনধরনের নিপীড়ন, নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবেনা। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কোনসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায় আচরন করা যাবেনা। কিছু ছাত্রসংগঠনের অন্তর্কোন্দল নিরসনে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডকে কঠোর হতে হবে। জুলুম, নির্যাতন করলে কিন্তু ছাত্র-জনতা জেগে উঠবে যে কোন সময়। এবারের আন্দোলন, অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে আর কখনো কেউ এদেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবেনা। সুতরাং এ কথা মাথায় রাখতে হবে সবাইকে। কে কি করেছে সেটা যদি আমিও করি তবে পার্থক্য থাকবে আর কই। এজন্য আমি মনে করি প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই সাধারণ মানুষের পাল্ স বুঝে চলতে হবে। ব্যতিক্রম হলে জনগণ কিন্তু ঘাড় ধরেই টেনে নামাবে। সুতরাং সাধু সাবধান!
আমি মনে করি, প্রকৃত সংস্কার ও তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলগুলো রাজনৈতিক অংগনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই সংস্কার অতি অবশ্যই করতে হবে দেশের মানুষের স্বার্থে। এর কোন বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট