নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনায় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

2

সুপ্রতিম বড়ুয়া

ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা। ভাবতে হবে তাদের নিয়ে। তাদের কাজের ধারাবাহিকতা আগের প্রজন্ম থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আমার নিজের সন্তানদেরকে প্রতিনিয়ত দেখছি ইন্টারনেট দেখে নতুন নতুন কিছু উদ্ভাবন। সাথে সাথে আমাদের শিক্ষার্থীরাও একইভাবে এগুচ্ছে। কারণ তারা ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট হাতে বড় হচ্ছে। ঘরে বসে গোটা বিশ্বকে দেখে বড় হয়েছে। যাদের চিন্তাভাবনায় জুড়ে রয়েছে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। আমাদের জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। যারা ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে। ডিজিটাল বিশ্বে জন্ম নিয়ে নতুন তরুণ প্রজন্ম সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশ আন্দোলন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি নতুন আবিষ্কৃত কাজের ক্ষেত্র নিয়ে বেশ সচেতন। তরুণ প্রজন্মের চিন্তাধারা, আচরণ এবং জীবনযাপন পদ্ধতি পুরোনো প্রজন্মের তুলনায় অনেক ভিন্ন। নতুন তরুণ প্রজন্মকে চিন্তাশীল, সহানুভূতিশীল ও পরিশ্রমী বলে আখ্যায়িত করছেন গবেষকরা। এই বিশাল প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার ওপরই নির্ভর করছে তারা কীভাবে দেশকে নেতৃত্ব প্রদান করবে। এটি আধুনিক যে কোনো দেশের সরকারি নীতি ও কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্নত দেশগুলো এক্ষেত্রে প্রায় শতভাগই সফল। তাদের নতুন প্রজন্ম বেড়ে ওঠে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো লাভের মাধ্যমে। ওরা শিশুকালে পুষ্টিকর খাবার যেমন পায়, চমৎকার শিশুসদনে তাদের শিশুকাল আনন্দের সঙ্গে বেড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে প্রকৃতি-মানুষ-প্রাণী-ফুল ও সব ধরনের প্রাণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে। খেলাধুলা আর আনন্দের মধ্যে তাদের শিশুকাল বেড়ে ওঠে। ওরা দেখে না কোনো বৈষম্যের সামাজিক সম্পর্ক। এরপর তাদের স্কুল যেন হয়ে ওঠে শেখা ও আনন্দের আধার হয়ে। এভাবেই উন্নত দেশগুলো তাদের শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য ও মানসিক গঠনে সব ধরনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেড়ে উঠতে দেয়।
একসময় শিক্ষাজীবন শেষ করে তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। খুব সামান্যসংখ্যক কিশোর-তরুণই রাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো শতভাগ হয়তো অর্জন করতে পারে না; কিন্তু তাদের জীবনও বেড়ে ওঠে নিয়মকানুন-আইন-বিধিবিধান-শৃঙ্খলা ও মানবিক আচরণের সঙ্গে পরিচয় লাভের মাধ্যমে।
আমাদের দেশের বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। আমরা এখনো শিশুদের সেভাবে গড়ে ওঠার শিশুকাল দিতে পারিনি। অনেকটাই পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে শিশুরা বেড়ে ওঠে। যারা ধনী পরিবার তাদের শিশুরা পুষ্টি এবং আনন্দময় শৈশবকাল যতটা পেয়ে থাকে, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কিংবা প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের সেটি হওয়া বা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও আমাদের দেশ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধীরে হলেও দারিদ্র্যের ব্যাপক প্রভাব থেকে অনেকটাই বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। এখন আমরা একটি নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছি। কিন্তু এই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বিষয়গুলো একেবারেই আপনাআপনি ঘটবে না। এটি ঘটবে তরুণ প্রজন্মকে আমরা যদি মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলেই কেবল আমাদের সম্পদের চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে। নতুবা আমাদের বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের আংশিকই কেবল দেশের জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারবে, বাকিদের বড় অংশই দেশের জন্য মঙ্গলের চাইতে অমঙ্গলই বেশি বয়ে আনতে পারে। এই বিষয়গুলো আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে উন্নত দেশগুলোর মতো করে শিশুকাল থেকে এদের মানুষ গড়ার পথ ও পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের নতুন প্রজন্মের সংখ্যা আনুমানিক ৬ কোটি। এদের জন্য আমাদের নিরাপদ শিশুকাল তৈরি করার ক্ষেত্র তৈরি করতেই হবে। এখনো অসংখ্য শিশু আমাদের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে পুষ্টিকর খাবার খেতে পায় না, আনন্দঘন শিশুও কিশোরকাল পরিবারে পায় না। তারা কতগুলো কুসংস্কার, বাধাধরা নিয়মশৃঙ্খলা এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসে বেড়ে উঠছে। শিক্ষার জন্য যে ধরনের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা বেশির ভাগ পরিবারই দিতে পারে না, এমনকি জানেও না। আমাদের এখানে শিশুদের পাঠের বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে পরিবারের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। বেশির ভাগ পরিবারই শিশুতোষ শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত নন। তারা তাদের বিশ্বাসমতো সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা নামধারী প্রতিষ্ঠানে এদের পাঠাচ্ছে। তারা সেখানে কী শিখছে, কীভাবে বেড়ে উঠছে, এই বেড়ে ওঠা তাদের মানুষ হিসেবে কিংবা জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে জানা ও সচেতন হয়ে ওঠার জন্য কতটা অনুক‚লতা কেউই খুব একটা তলিয়ে দেখছে না। এসব প্রতিষ্ঠান খুব একটা নিয়মনীতি, শিক্ষার কারিকুলাম, দর্শন ইত্যাদিকে মেনে চলছে বলে মনে হয় না। অনানুষ্ঠানিক এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর জীবনের প্রথম স্তরটি যখন অতিক্রম করে, তখন তারা অনেক কিছুই শিখতে পারে না, জানতে পারে না; এমনকি মানসম্মত পঠন-পাঠনও তাদের অর্জিত হয় না। ফলে বিপুলসংখ্যক শিশুর জীবন অব্যবস্থাপনার ভেতরে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খায়। এদের মধ্য থেকে খুব কমসংখ্যক শিশু-কিশোরই প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারছে। কিংবা বেরিয়ে আসতে পারছে। আমাদের যেসব অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যেও রয়েছে মানের তারতম্য, বৈষম্য এবং পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গির নানা ধরনের ব্যবস্থা। ফলে বিজ্ঞানের এই যুগে অনেক শিক্ষার্থী অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও বিজ্ঞান সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ও জ্ঞানার্জন নিয়ে বের হতে পারছে না। যেসব শিক্ষা আমাদের এখানে রয়েছে, তা দিয়ে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী নিজেদের কোনো না-কোনো জ্ঞান শাখায় মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ এবং সৃজনশীল বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। আমাদের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ধারার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোতেও নেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা সৃষ্টির পরিবেশ—শিক্ষক-শিক্ষাক্রম, ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রভাবনা ও বিশ্বপরিচয়ে নিজেদের তৈরি করার পরিবেশ। ফলে আমরা যেসব প্রজন্মকে বছরের পর পর এই সমাজব্যবস্থায় বেড়ে উঠতে দিচ্ছি, তাদের রাষ্ট্র-সমাজ, বিশ্ববাস্তবতা, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠার জ্ঞানতাত্তি¡ক তেমন কোনো ধারণাই তাদের দিতে পারছি না। এ কারণে আমাদের দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মেধাবী তরুণ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশে তারা পড়াশোনা এবং গবেষণার মাধ্যমে খ্যাতিও অর্জন করছে। অথচ এরা আমাদের দেশে যদি সেই সুযোগগুলো পেত, তাহলে তাদের বিদেশে পাড়ি জমানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। যারা দেশের অভ্যন্তরে লেখাপড়ায় যুক্ত আছে, তাদেরও আমরা পরিপূর্ণ শিক্ষিত, মেধাবী, যোগ্য এবং আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিতে পারছি না। আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানান্বেষণের তেমন পরিবেশ দিতে না পারার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাসনদ লাভের চাইতে বেশি কিছু জ্ঞানচর্চার কোনো ধারাতেই যুক্ত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেই রাজনীতির পেছনে নিজেদের যুক্ত করছে। কিন্তু যেসব ছাত্রসংগঠন ছাত্ররাজনীতির নামে এখন শিক্ষাঙ্গনে অবস্থান করছে, তাদের না আছে দেশ, জাতি এবং ভবিষ্যৎ মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলার রাজনৈতিক দর্শনচর্চা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, না আছে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা; আর সামাজিক দায়বদ্ধতা তো আরো দূরের বিষয়। বরং বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় একধরনের ঢিলেঢালা অবস্থায় শিক্ষাজীবন অতিক্রম করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একুশ শতকের জ্ঞানবিজ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন সমাজচেতনা, বিজ্ঞানচেতনা এবং প্রায়োগিক জীবনবোধ অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। এদের পড়াশোনার জগত সীমিত হয়ে আসছে। বইপুস্তক যেভাবে সংগ্রহ ও পড়াশোনা করার তাগিদ রয়েছে, সেটি খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। খুব সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলার চেষ্টা করে থাকে। এর বাইরের বড় অংশই বর্তমানকে নিয়েই আবদ্ধ থাকতে চায়। পুরোনো ধ্যানধারণা বিশ্বাসবোধ এবং আচার-আচরণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে শিক্ষিত নামধারী হয়েও এরা খুব বেশি সৃজনশীল আদর্শিক ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা কিংবা রাষ্ট্র বিশ্বজনীন ব্যবস্থায় নিজেদের যুক্ত করছে না। এই তরুণদের বাইরে অসংখ্য তরুণ অর্ধশিক্ষা কিংবা মানহীন শিক্ষা নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারছে না। আবার অনেকেই লেখাপড়ার জীবন থেকে অনেক আগেই ছিটকে পড়েছে।
সমাজের নানা অব্যবস্থাপনার সঙ্গে কিছু তরুণ যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আমাদের সমাজে বখাটে, সন্ত্রাসী, নানা ধরনের অপরাধ কর্মকান্ড প্রতিনিয়ত দেখতে হচ্ছে, রাষ্ট্রকে এসবের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে যুক্ত থাকতে হচ্ছে। আমাদের সমাজ যেভাবে তরুণদের মেধা-মনন ও দক্ষতা ব্যবহারসমৃদ্ধ হতে পারত, সেটি অনেকাংশেই দেখা যাচ্ছে না। এখনকার তরুণদের মধ্যে অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার যে পরিমাণ দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশই শুধু নানা ধরনের আয় ও উৎপাদনশীলতার কাজে কিংবা আউটসোর্সিং করে উন্নত জীবন অর্জন এবং দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার কৃতিত্ব দেখাতে পারছে। কিন্তু বড় একটি অংশ দেশের অভ্যন্তরে কিংবা দেশের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বিরূপ অপপ্রচার এবং নিজেদের নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রাখার যথেষ্ট প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। এটি আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। আমাদের রাষ্ট্র এই তরুণদের যেহেতু আগে থেকেই আধুনিক ধ্যানধারণা, জ্ঞান ও বিচার বিশ্লেষণে দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ দিতে পারেনি, তাই এরা দেশের জন্য অনেকটাই হুমকি হয়ে উঠছে। এখন সমাজসচেতন মানুষ ও সরকারকে ভাবতে হবে আগামী প্রজন্মের কথা, যারা শুধু দৈহিক নয়, মানসিক ও চেতনাগতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কল্যাণকামী সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির কাজে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। তাই দৃশ্যমান হয়ে উঠা নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারাকে দ্রুত কাজে লাগাতে হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, রামু সরকারি কলেজ