নতুন উত্থানে বিকল্প রাজনীতির আভাস

14

এম এ হোসাইন

চট্টগ্রামে টানা তিনদিন পথসভা ও জনসংযোগ চালিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি উপজেলা ও নগরীর কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। পিকআপ ভ্যানে চড়ে বিভিন্ন মোড়ে বক্তব্য দিয়েছেন, সরাসরি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজনৈতিকভাবে অপরিচিত একটি দলের এতোটা সরব উপস্থিতি এখন আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে তরুণদের উপস্থিতি, নারীদের অংশগ্রহণ ও কিছুটা বিদ্রোহী সুর রাজনীতির মাঠে নতুন ধারার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এনসিপির পথসভাগুলোর বক্তব্য ছিল প্রচলিত রাজনীতির ফরমায়েশি ভাষার বাইরে। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্য ও রাজনৈতিক সাহস তরুণদের আগ্রহ বাড়িয়েছে।
গতকাল চকবাজার এলাকায় পথসভায় হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে আপনারা যোগ্য নেতৃত্বকে ভোট দেবেন। যদি দেখেন এনসিপি থেকে যোগ্য নেতৃত্ব নাই, আমাদেরকে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মার্কা দেখে ভোট দেওয়ার দরকার নাই। যে সবার সেবা করবে, তাকে আপনারা ভোট দেবেন।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু হবে আমাদের পরিবার থেকে। আমার বাবার ইনকামের স্বচ্ছতা আছে কিনা, সেই প্রশ্ন করার সৎ সাহস থাকতে হবে। আপনার বাবার বেতন ৪০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিচ্ছে ২৫ হাজার টাকা, আপনাকে আইফোন কিনে দিচ্ছে দেড় লাখ টাকার। আপনার বাবার ইনকাম নিয়ে যদি প্রশ্ন করতে না পারেন, তাহলে আপনার যথাযথ শিক্ষা এখনও পর্যন্ত হচ্ছে না।
এই জনসংযোগ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ডা. মাহমুদা আলম মিতু, মো. আতাউল্লাহ এবং সংগঠক আরমান হোসাইন ও আজিজুর রহমান রিজভী।
এনসিপি নেতারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকের কাছ থেকে উদ্বেগ-প্রত্যাশার গল্প শুনেছেন। আর তাদের রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন পাড়া-মহল্লায়। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে তাদের কর্মসূচি শেষ হয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে কর্মসূচির মূল্যায়নও করছেন নেতারা।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা তার ফেসবুক পোস্টে চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করেন। সোমবার করা সেই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আজ চট্টগ্রামের নয়টি জায়গায় গিয়েছি। মানুষের কথা শুনেছি, তাদের উদ্বেগ জেনেছি, আর দেশ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার কথা বলেছি। তবে দিনের দুটি মুহূর্ত আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। প্রথমটি ছিল এক ছোট্ট মেয়ে সুহানাকে ঘিরে। সে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি এক স্থানীয় ফার্মেসিতে ঢুকেছিলাম দোকানদার ভাইয়ের সাথে কথা বলার জন্য। হঠাৎ সুহানা আমাকে চিনে ফেলে। বলে উঠল, “ছাত্রদের দলকে আমি চিনি!” কোন দ্বিধা না করেই সামনে এগিয়ে এসে সেলফি তুলল। আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে সুহানা নির্ভয়ে, নিরাপদে, সম্মানের সাথে আর আনন্দে বড় হতে পারবে। দ্বিতীয় মুহূর্তটি ছিল দিনের শেষে। শহীদ ওমরের মায়ের সঙ্গে দেখা হলো বোয়ালখালীতে। তিনি এসেছিলেন ছেলের কবর তৈরির খোঁজ নিতে। শুনেছেন আমরা কিছুক্ষণ পর আসছি, তাই থেকে গিয়েছিলেন। কী দৃঢ়তা তাঁর কণ্ঠে। বললেন, তিনি ছেলের মৃত্যু মেনে নিয়েছেন। এটাকে তিনি মহৎ উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ হিসেবে দেখেন। কিন্তু ওমরের বাবার এখনও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, এমনকি দৈনন্দিন কাজও করতে পারেন না। ওমর ছিল এক মেধাবী তরুণ। পড়াশোনা প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। বাংলাদেশ বিমানে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অথচ মুহূর্তেই রাষ্ট্র তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। আমরা প্রায়ই হাই পলিটিক্স (অর্থাৎ জটিল তত্ত¡, রাষ্ট্রের সংস্কার) নিয়ে কথা বলি। কিন্তু একটা রাষ্ট্র কখনোই যেন এমন অবস্থায় না ফিরে যায়, যেখানে সে নিজের সন্তানদের হত্যা করতে পারে – এ বিষয়ে তো আমাদের সবার একমত হওয়া উচিত। এটাই আমাদের দায়িত্ব; ওমরের কাছে, তার পরিবারের কাছে, আর প্রতিটি শহীদের কাছে, যারা তাদের জীবন দিয়েছেন।’
এনসিপির এ উদ্যোগকে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি নতুন মাত্রা হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, পথসভাগুলোতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং মানুষের সরাসরি সাড়া দলটির মনোবল চাঙ্গা করবে। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এনসিপির উপস্থিতি একটি ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এটি প্রচলিত দলগুলোর মতো নয়, বরং জনগণের সাথে সরাসরি সংলাপে বিশ্বাসী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির বার্তাগুলো ছিল খোলামেলা, জনতাবান্ধব এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা, পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং ভোট বিক্রি না করার আহবান বর্তমান বাস্তবতায় সাহসী কণ্ঠস্বর। চট্টগ্রামকে ঘিরে এনসিপির এই তৎপরতা রাজনীতির ময়দানে একটি বিকল্প সত্তার অস্তিত্বের আভাস দিচ্ছে। দলটি কোনো প্রথাগত দল না হয়েও ধারাবাহিক সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের ছাপ রাখছে।
এনসিপির মিডিয়া মুখপাত্র আরফাত আহমেদ রনি বলেন, আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য, ক্ষমতার জন্য নয়। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের কথার ভিত্তিতে আমরা আগাবো। এই পথসভা ছিল সেই পথচলার শুরু।
এনসিপি নেতারা জানান, চট্টগ্রামে এই তিনদিনের পথসভা হয়তো একটি নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতির অংশ নয়। বরং এটি হতে পারে জনগণকেন্দ্রিক এক বিকল্প রাজনৈতিক ভাষ্য গড়ে তোলার সূচনা। যার ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা, নাগরিক অধিকার ও মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতি।