কাগজে-কলমে চট্টগ্রাম নগরীতে খালের সংখ্যা ৫৭। তবে ক্রমাগত দখল-দূষণে এখন ৩৬টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাকি ২১টির অবস্থা এমন যে কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই সেখানে কখনো খাল ছিল। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬টি খাল খনন ও সংস্কার করার কারণে সেগুলো কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তথ্যমতে, চসিক এলাকায় এক সময় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৭টি খাল ছিল। এর মধ্যে ১৬টি খাল বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। এছাড়া বিভিন্ন খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে ৩১টি, যার মধ্যে ১৭টি সরাসরি কর্ণফুলীর সঙ্গে সংযুক্ত। বাকি ১০টি খাল হালদা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এসব খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার। তবে ইতিহাস বলছে, নগরীতে একসময় ১১৮টি খাল ছিল, যার বেশির ভাগেরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। সিডিএর মেগা প্রকল্পেও ৫৭টি খালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে ৫৬টি খালের কথা বলা হয়েছে। ৫৭টির মধ্যে বর্তমানে নগরীতে চলমান জলাবদ্ধতা প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল সংস্কার করে এগুলোর দুই পাশে রিটেইনিং ওয়াল এবং সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। খালগুলোর ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এ বিপুল কর্মযজ্ঞে ছিল না দখলে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ২১টি খালের কথা। সিএস খতিয়ানে এসব খালের অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে এখন বহুতল ভবনসহ নানা ধরনের স্থাপনা রয়েছে। দখল হওয়া ২১টি খালের খালের মধ্যে ১৬টি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। এগুলো হলো স্লুইস নং-১ (এসএস) সংযোগ খাল, স্লুইস নং-২ (চরপাড়া), স্লুইস নং-৮ (হোসেন আহমদ পাড়া), স্লুইস নং-৯ (নতুন সাইড পাড়া, সিইপিজেড), স্লুইস নং-১০ (সিইপিজেড),স্লুইস নং-১০ (আনন্দ বাজার), স্লুইস নং-১১ (উত্তর হালিশহর), স্লুইস নং-১১ (কাট্টলী), স্লুইস নং-১২ (উত্তর কাট্টলী),স্লুইস নং-১২ (ডিএস সংযোগ খাল, উত্তর কাট্টলী), স্লুইস নং-১৩ (লতিফপুর), স্লুইস নং-১৪ (সলিমপুর), স্লুইস নং-১৫ (সলিমপুর), স্লুইস নং-১৬ (বাংলাবাজার), বৈরাগ্য ছড়া খাল এবং বামাইর খাল। এছাড়া মির্জাখাল, বালুখালী খাল, কৃষ্ণা খাল, কুয়াইশ খাল, ফরেস্ট খাল কর্ণফুলী ও হালদা নদীর সঙ্গে মিশেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা সমস্যা অনেক পুরনো। নগরীতে একসময় আমরা ছোটবেলায় অনেক বড় খাল ছিল। এখন সেগুলো ড্রেনে পরিণত হয়েছে, না হয় সেখানে খালগুলো দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব খাল উদ্ধারের বিষয়টি জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই নেয়া উচিত ছিল। যে ২১টি খাল উদ্ধারের প্রসঙ্গ এসেছে, সেটি করতে অন্তত ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আপনি এক বা দুই বছরের জন্য খাল উদ্ধার করলেন আবার পরে তা দখল হয়ে গেল, সেভাবে কাজ করলে হবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানান, এ বছর চট্টগ্রাম নগরের ২১টি খাল পরিষ্কারের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে কাজ। বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত বারইপাড়া খালটি খনন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬৫ ফুট প্রস্থের এ খাল খনন সম্পন্ন হলে নগরের নাসিরাবাদ, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, শুলকবহর, বারইপাড়া ও বাকলিয়া এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে প্রথম ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এই প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। এরপর অন্তত পাঁচ দফা মেয়াদ বাড়িয়েও এর কাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বর্তমানে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৬২ কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, চট্টগ্রাম নগরীতে এক সময়ে ১১৮টির বেশি খাল ছিল। কিন্তু নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দখল-দূষণের কারণে অনেক খাল ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। কিছু খাল আছে যেগুলো দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে এগুলো একসময় প্রশস্ত ও প্রবাহিত জলাধার ছিল। এসব খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে নগরীজুড়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এখন দখলদার হাত থেকে খালগুলো রক্ষা করাই সিটি করপোরেশন, সিডিএ কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি করা গেলে জলজটের হাত থেকে রেহাই পাবেন বন্দরনগরীর মানুষ।