নগরীর গলার কাঁটা ব্যাটারি রিকশা অরক্ষিত খাল-নালা

1

মো. দিদারুল আলম

সম্প্রতি চকবাজার কাপাসগোলা এলাকার নবাব হোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে নালায় পড়ে রিকশার দুই যাত্রীর মধ্যে মায়ের কোলে একটি ছয় মাসের বাচ্চা ছিল। বৃষ্টির পরপরই নালার স্রোত বেশি থাকার কারণে বাচ্চাটি তলিয়ে গেছে। ওই শিশুর মা ও অপরজনকে উদ্ধার করা গেলেও শিশুটি পানির স্রোতে নিমিষেই হারিয়ে গেছে। ১৪ ঘণ্টা পর শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অরক্ষিত নালায় গত ছয় বছরে নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ জন, ২০২১ সালে ৫, ২০২৩ সালে ৩, ২০২৪ সালে ৩ ও চলতি বছর ১ জন। ২০২০ সালের ২১ জুলাই নগরের মহেশখালে পড়ে মৃত্যু হয় মুন্নি আক্তার ও ঝুমা আক্তার নামের দুই কিশোরীর।
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রকল্পের কাজে নালা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে আছে বেশিরভাগ নালা। এসব খোলা নালা-খাল নগরবাসীর মারণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই ড্রেনগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। আমরা রিক্সায় থাকি কিম্বা হেঁটে যাই – যেভাবেই রাস্তা দিয়ে যাই না কেন অন্যান্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি এখন এই ড্রেনে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বিরাট ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবে, নগরে উন্মুক্ত নালা-নর্দমা ও খালে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি। এর মোট দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, পথচারীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য গত তিন বছরে প্রাায় ২৫ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত এবং নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ খালের পাড়ে ১৫ হাজার বর্গফুট রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নালা-নর্দমায় কয়েক হাজার মরণফাঁদ রয়েছে।
খাল-নালায় পড়ে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এবং অনেকেই মারাত্মক আহত হচ্ছেন। কিন্তু কারও টনক নড়ছে না। এখনো নগরের বেশিরভাগ খাল-নালা উন্মুক্ত। যেখানে স্ল্যাব বসানোর উপায় নেই, সেখানে বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করা উচিত। নিরাপত্তাবেষ্টনীহীন খাল-নালার ঝুঁকি নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরের বেশিরভাগ বাসিন্দা। প্রতিটি মৃত্যুর পর খাল-নালায় প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার দাবি জানানো হয়। কিন্তু বছর ঘুরে আবার দুর্ঘটনা হলেও ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয় নগরবাসীকে। আজ নগরের মুরাদপুর ছাড়াও বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, ২ নম্বও গেট, মেয়র গলি, আল ফালাহ গলি, মেহেদিবাগ, বাকলিয়া এলাকায় দেখা গেছে, নালার ওপর কোথাও স্ল্যাব আছে, কোথাও নেই। আবার কোথাও স্ল্যাব ভাঙা। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। গত এক মাসে জলাবদ্ধতায় অন্তত আটবার ডুবেছে এসব এলাকা। এ কারণে নগরবাসীর মনে ভয় আরও বেড়েছে।
খাল-নালায় পড়ে কেউ মারা গেলে দু-চার দিন আলোচনা হয়। এরপর আবার সব থেমে যায়। কিন্তু এসব উন্মুক্ত খাল-নালাকে ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। তাই আর বিলম্ব না করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। খালের পাড়ে এবং নালা ও ফুটপাতের মাঝখানের অংশে রেলিং কিংবা লোহার দিয়ে বেষ্টনী দিতে হবে। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার কাপাসগোলা হিজলা খালে বেপরোয়া গতির একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা পড়ে ৬ মাস বয়সী এক শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় ফের আলোচনায় এসেছে এই যানটি। ঘটনাটি নতুন করে সামনে এনেছে চট্টগ্রাম নগরীতে চলমান ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে নানা সমস্যা ও জটিলতা।
নগরীতে চলাচলকারী প্রায় ৫০-৫৫ হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশা থেকে প্রতিদিন উঠছে কোটি টাকার চাঁদা। এ চাঁদার ভাগ বিভিন্ন মহলে পৌঁছালেও কেউ এর দায় নিচ্ছে না। বিদ্যুৎ অপচয়, যানজট সৃষ্টি, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন এই রিকশা থেকে একজন চালক গড়ে ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা আয় করেন। পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিয়ে রিকশা বন্ধ করা হলে তা হবে তাদেও পেটে লাথি মারার শামিল। ফলে তারা আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। অযান্ত্রিক এসব যানবাহন যাত্রী এবং অন্যান্য গাড়ির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই গাড়ির যে কাঠামোতে তৈরি, এর সঙ্গে গতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে রাস্তায় হামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেই সুযোগে নগরীর প্রতিটি প্রধান সড়কে চলাচল করতে দেখা যায় নিষিদ্ধ অটোরিকশা। দ্রুতগতি, অদক্ষ ও শিশু চালকদের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় এই রিকশাগুলো। এছাড়া যত্রতত্র পার্কিং করে নগরজুড়ে যানযটের অন্যতম কারণও এসব রিকশা। তাই সিএমপি ০৯ সেপ্টেম্বর প্রধান সড়কে এসব গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এ নিয়ম কেউ মানেনি।
ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুৎ ঘাটতির সময়ে অবৈধ এই যানবাহন চলতে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। এছাড়া এই বাহন নিরাপদও নয়। সাধারণ রিকশার অবকাঠামো কিছুটা পরিবর্তন কওে তৈরি এসব রিকশা বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। এতে প্রায়ই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে।
নগরীতে মাত্রারিরিক্তভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেড়ে গেছে। এগুলো বন্ধ করার কথা বললে অনেকেই পুনর্বাসনের কথা বলে এবং বন্ধ করলে তারা সংসার কীভাবে চালাবে তা নিয়ে কথা বলে। কর্তৃপক্ষকে এগুলো শুনলে হবে না। বর্তমানে নগরীতে যানজট বাড়ার অন্যতম কারণ হলো প্রায় সবকটি সড়কে ব্যাটারি রিকশার আনাগোনা। মেডিকেলে গেলেই দেখা মিলে কী পরিমাণ যাত্রী ব্যাটারি চালিত রিকশায় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। সবকিছু চিন্তা করে ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধ করতেই হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক