নগরে এতদিন বিভিন্ন অলিগলিতে চলাচল করলেও এবার সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগরে চলাচলে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অদৃশ্য কোন এক শক্তির বলে এসব গাড়ি দেদারছে চলছে চট্টগ্রাম মহানগরীতে। আর এ চলাচলকে আরও বেগবান করতে কয়েকটি সংগঠন মিলে গড়ে তোলা হয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
সূত্রমতে, বিদ্যুতের চোরাই লাইনের মাধ্যমে চার্জ দিয়ে কোটি টাকার বিদ্যুৎ অপচয় করে চললেও এসব বন্ধে নেই তেমন কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে অত বেশি তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অসাধু গ্যারেজ মালিকরা এর সুবিধা গ্রহণ করছেন। এছাড়াও মাঝে মধ্যে কিছু রিকশা আটক হলেও সামান্য জরিমানা দিয়ে এগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও নামানো হয় রাস্তায়। তারা বিভিন্ন মহলে ম্যানেজ করে আবার সড়ক মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ায়।
বর্তমানে বিশাল অংকের চাঁদাবাজির মিশন নিয়ে ৩১০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করে বাধাহীনভাবে এসব রিকশা চালানোর জন্য একটি সিন্ডিকেট গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাঠে অবস্থান নেয়ার জন্য চালক মালিকদের ক্ষিপ্ত করার উদ্দেশে তাদের মাঝে উস্কানিমূলক লিফলেট বিলি করা হচ্ছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশামালিক সমিতির ব্যানারে এ কার্যক্রম বর্তমানে ছোট পরিসরে চলমান রয়েছে। বৃহৎ পরিসরে চালানোর জন্য সিন্ডিকেটটি বিভিন্ন মহলে জোর তদবিরও চালিয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে নগরীতে একদিকে যেমন বাড়বে যানজট ও দুর্ঘটনা, অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকার বিদ্যুত অপচয় হবে।
জানা গেছে, গত ৪ মে রাত ৮টায় একটি মিটিংয়ের মাধ্যমে ১৩টি শর্ত দিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। যেখানে ৯নং শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে- নগরীতে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে চলাচলকারী সকল ইলেকট্রিক চার্জার রিকশার বডিতে ‘চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা নিরাপদ চলাচল ও নিবন্ধন বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর মুদ্রিত পরিচিতি স্টিকার/প্লেট লাগানোর ব্যবস্থা করা হবে। বাস্তবায়ন পরিষদের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে এককালীন এন্ট্রি ফি, পরবর্তী সার্ভিস চার্জ বা অন্য কোনো আদায় বাস্তবায়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হবে। পরবর্তীকালে এ সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গ্রহণ ও কার্যকর করবে, যা বাদ বাকি সকলে মানতে বাধ্য থাকবেন।
চুক্তিপত্রের ১০নং শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবায়ন পরিষদের স্টিকার/প্লেটযুক্ত কোনো চার্জার রিকশা প্রশাসনিক হয়রানি অথবা চুরি-ছিনতাইসহ অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি কর্তৃক গঠিত সাব-কমিটি এ ব্যাপারে যথাযথ কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সমন্বয় কমিটির নিকট তারা রিপোর্ট ও জবাবদিহি করবে। চট্টগ্রাম ইলেক্ট্রিক চার্জার রিকশা মালিক সমিতির পক্ষে সমঝোতা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি ওয়াজি উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগরী রিকশা মালিক পরিষদের (রেজি. নং-চট্ট. ১৯৯৩) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম মহানগরী রিকশাচালক ইউনিয়নের (রেজি. নং-চট্ট. ২১১২) সভাপতি মো. ফরিদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ এবং চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজি. নং- চট্ট.১৪৪১) সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ। এই ৪টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা নিরাপদ চলাচল ও নিবন্ধন বাস্তবায়ন পরিষদ, সংক্ষেপে যার নাম হবে বাস্তবায়ন পরিষদ।
সমঝোতা চুক্তির বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী রিকশা মালিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, আমরা ব্যাটারি রিকশা চলাচলের বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম সরকার সড়ক আইনের ৪৬ এর ৪ ধারা সংশোধন করবে। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের নিষেধাজ্ঞাটা উঠে যাবে। কিন্তু সরকার তো সে রকম কিছু করেনি। সুতরাং চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভুল করেছি।
চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, কিছু সিএনজি ট্যাক্সি মালিকের শরীরে চর্বি চলে আসাতে আমি এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। সিএনজি চালকদের উপর অমানবিকতা দেখাচ্ছে ওইসব মালিক। তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যা যা করা দরকার সংগঠনের নেতা হিসেবে তাই করা হবে।
স্ট্যাম্পে চুক্তির বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা মালিক সমিতির সভাপতি ওয়াজি উল্লাহ বলেন, ব্যাটারিরিকশা চলাচলের বিরুদ্ধে আমিও ছিলাম। তবে আমরা নতুন মডেলের একটি রিকশা অনুমোদন দেয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে পাঠিয়েছি। যেটি হবে পরিবেশবান্ধব আর যথেষ্ট নিরাপদ বাহন। ইতোমধ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন কিছু ব্যাটারি রিকশা অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে চট্টগ্রামে দিতে অসুবিধা কোথায়? এছাড়া ব্যাটারি রিকশা চলাচলের জন্য আমরা একটা প্লাটফর্ম তৈরি করেছি মাত্র। এককালীন এন্ট্রি ফি এবং আদার চার্জ আদায়ের পরিমাণ ও পদ্ধতি ওই কমিটি নির্ধারণ করবে। একই সাথে ব্যাটারি রিকশা নগরীতে চলাচল করার জন্য যা যা করা দরকার তা করতে প্রস্তুত আমরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, এসব চার্জার রিকশায় চার্জ দেয়ার জন্য পিডিবির কোনো সংযোগ দেয়া হয় না। তবুও বর্তমানে চুরি করা বিদ্যুতে চার্জ দিয়ে এমনিতেই নগরীতে অনেকগুলো গাড়ি চলমান আছে। আবার যদি এভাবে চুক্তি করা হয়ে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ অন্যায় হবে। আর আদালত বা প্রশাসন যদি এসব রিকশা চলাচলের অনুমোদন দেয় তাহলে যানজট ও দুর্ঘটনার পাশাপাশি নাগরিক দুর্ভোগ বাড়বে, শুরু হবে বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাময়িক কিছু অর্থ পেলেও ক্ষতির মুখে পড়বে পিডিবি এবং বৈধ প্যাডেল চালিত রিকশা ও সিএনজি ট্যাক্সির চালক-মালিকরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম বিতরণ দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু বলেন, বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাটারি রিকশা গ্যারেজ বন্ধ করতে আমাদের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। আমার অধীনে সকল নির্বাহী প্রকৌশলীদের বলে দেয়া হবে, যাতে তারা তাদের এলাকার রিকশা গ্যারেজগুলো বের করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (শহর ও যানবাহন) শ্যামল কুমার নাথ জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কাজেই নগরে এগুলোর চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব ব্যাপারে কোন ছাড় নয়। মহাসড়কে কোনভাবেই ব্যাটারিরিকশা চলতে পারে না, অলি-গলিতে চলতে পারে। তবে সেখানে অভিযান চালানোর মত সক্ষমতা আমাদের নেই।