নগরবাসীর ‘নজর কাড়ছে’ মায়াবী রূপের ডিসি পার্ক

13

আবু মোশাররফ রাসেল

মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মাথার ওপর ছায়া দিয়ে যায় সারিবদ্ধ ব্যতিক্রমী অনেকগুলো তোরণ। ব্যতিক্রমী-এ কারণেই বলছি, তোরণগুলো সাধারণ অর্থে শামিয়ানা টানানো কিছু নয়; উল্টো ইউ আকৃতির অ্যাঙ্গেল করা কাঠের ফ্রেমের দুইপাশজুড়ে ঝুলে আছে শত শত ফুলের টব, টবে ফুটে আছে নানা প্রজাতির ফুল। হঠাৎ করে মনে হবে-অন্যরকম এক জগতে ঢুকে গেছেন! তবে এটা কেবল শুরু, তোরণ পেরিয়ে যেতে যেতে আসল সৌন্দর্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন, মুগ্ধতার শুরুটাও এখানেই। সামনে যতই পা বাড়াবেন-প্রকৃতির বিশালতা, মনোরম জলাশয়ে প্যাডেল বোটের কায়াকিং কিংবা খোলা আকাশের নিচে ‘ফুলের রাজ্যে’ হারিয়ে যাবেন।
থাক, আর কথা না বাড়িয়ে এটি কার সৌন্দর্যের বর্ণনা শুরু করেছি, সেটি একটু বলে নেওয়া যাক। বলছিলাম, সীতাকুন্ডের ডিসি পার্কের কথা।
সীতাকুন্ডের নাম শুনলেই প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে এক ধরনের টান অনুভ‚ত হয়। উত্তর চট্টগ্রামের এই উপজেলা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি। সাগর, নদী, প্রাকৃতিক ছড়া-ঝর্না আর পাহাড়ের মায়াবী সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে সৗতাকুন্ড প্রকৃত অর্থেই যেন এক ‘মায়াবী রূপের রাণী।’ আর ডিসি পার্ক যেন সত্যিকার অর্থেই সমস্ত রূপকে একই অঙ্গে ধারণ করে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে চারদিকে।
বলা যায়Ñএকই ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত শহর চট্টগ্রাম। কিন্তু মানুষের প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকাÐ আর আবাসনের আগ্রাসনে চট্টগ্রাম শহর এখন প্রায় ‘সবুজ শূন্য’ অবস্থায়, ইট-পাথরের খাঁচায় বন্দী শহুরে মানুষের জীবন। নানা কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে শহরের বিনোদনের ক্ষেত্রও। এ অবস্থায় একটু ‘বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে’ মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চানÑএই আকাক্সক্ষাকেই যেন সার্থক করে তুলছে সীতাকুন্ডের ডিসি পার্ক। শহরের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত এই পার্কটিই এখন নগরবাসীর নজর কেড়েছে, পারিবারিক বিনোদনের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে এটি।
গত শুক্রবার ডিসি পার্কে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়েসী পর্যটক, নারী-পুরুষ-শিশু, পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে এসেছেন বেড়াতে। টিকেট কাটার জন্য দীর্ঘ সারি তো আছে, প্রবেশমুখেও জটলা দেখা গেলো। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের চৌকস ব্যবস্থাপনা টিমের কারণে সুশৃঙ্খলভাবে পর্যটকরা পার্কে প্রবেশ করছেন। পার্কে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. নজরুল ইসলাম ওয়াকিটকি হাতে সবকিছু তদারকি করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘ডিসি পার্কের সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা বেড়াতে আসছেন। চট্টগ্রাম শহর থেকে পরিবার-পরিজনসহ অনেকে বেড়াতে আসেন। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার দর্শনার্থী আসেন, ছুটির দিনগুলোতে এই সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি হয়।’ তিনি জানান, ছাদখোলা দ্বিতল পর্যটক বাস সীতাকুন্ডের ডিসি পার্কে আসার কারণে রোমাঞ্চক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সুযোগ নেন অনেক পর্যটক। প্রতি শুক্র ও শনিবার এবং ছুটির দিনগুলোতে পর্যটক বাস একটি বিশেষ প্যাকেজের আওতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে যায়। এর মধ্যে ডিসি পার্কও অন্তর্ভুক্ত।
ডিসি পার্কের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম পূর্বদেশকে বলেন, ‘অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার চট্টগ্রাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে সীতাকুন্ডের ডিসি পার্ক। এই পার্কটির সৌন্দর্য এবং সুবিধা সব বয়সী পর্যটককে মুগ্ধ করে, পারিবারিক বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবেও এটি বেশ উপভোগ্য। পার্কটিকে আকর্ষণীয় করতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেক উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী ‘ফুল উৎসব’ করেছি আমরা। এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে জেলা প্রশাসনের একটি চৌকস সমন্বিত টিম। এটিকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আগামীতে আরও কিছুৃ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।’
চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকা থেকে পরিবার-পরিজনসহ ডিসি পার্কে বেড়াতে আসা শারমিন আকতার পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখানকার বড় বড় লেকগুলোতে বোটে চড়ার মজাই আলাদা। বাচ্চাদের খেলাধূলা ও আনন্দের জন্য এখানে যে রাইডস আছে সেগুলোতে তারা অনেক আনন্দ উপভোগ করে। এ জন্য সময় সুযোগ পেলে ডিসি পার্কে বেড়াতে আসি।’
ঢাকা থেকে আসা তরুণ মনিরুল হুদা বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে ডিসি পার্ক কেবল একটি উদ্যান নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম। এখানে এসে মানুষ শুধু চোখের আরাম পায় না বরং প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনের ক্লান্তি যেন ভুলে থাকা যায় কিছুটা সময়।’
পার্কের মাঝে বড় বড় দুটি লেক-এর মধ্যে একটিতে রয়েছে ভাসমান রেস্টুরেন্ট। কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে লেকের মাঝখানে গিয়ে নাশতা করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পর্যটকদের দেয় ভিন্ন আমেজ।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সীতাকুন্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের ফৌজদারহাট এলাকায় ডিসি পার্কের অবস্থান। ১৯৪ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক বিশালতার এক অন্যরকম উদ্যান। এক সময় পরিত্যক্ত থাকা এই জায়গাটি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দখলদারমুক্ত করে সংস্কার করা হয়। সেখানে গড়ে তোলা এই ছায়াযুক্ত আরামদায়ক উদ্যানটি এখন ভ্রমণপ্রেমী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য।
প্রতিষ্ঠাকালীন সাত দিনের ফুল উৎসব আয়োজন করে পার্কটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ সুদৃঢ় করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ফুলের বাগান, কায়াকিং ও নৌকাভ্রমণ, রেস্টুরেন্ট, কিংস কর্নার, কিডস জোন ইত্যাদি সুবিধা সংযোজন করে পার্ককে সমৃদ্ধ করা হয়। পার্কের কেন্দ্রে সাজানো হয়েছে ১৩৬ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফুল দিয়ে। পার্কের মাঝখানে দুটি বিশাল আকারের লেকে নৌকাভ্রমণ ও কায়াকিং করা যায়।
এছাড়াও রয়েছে সানসেড ভিউ পয়েন্ট; যেখানে সমুদ্র উপক‚লবর্তী অবস্থানে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। রয়েছে সেলফি কর্নার; যেখানে ক্যামেরাভিযুক্ত পর্যটকদের জন্য রঙিন ইনস্টলেশন, প্রাকৃতিক ব্যাকড্রপসহ বিভিন্ন থিমে সেলফি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিডস জোনে রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য নিরাপদ ও সৃজনশীল গেমিং আর আমোদ-প্রমোদ অঞ্চল। বৃত্তাকার পথে হাঁটার ওয়াকওয়েজুড়ে ছড়িয়ে আছে মনোমুগ্ধকর ফুলের শ্যামলিমা; যেখানে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতে থাকবে এ যেন এক ‘ফুলের রাজ্য।’