এম এ হোসাইন
গাড়ির ইঞ্জিনের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লুব্রিকেন্ট বা ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা অপরিহার্য। কিন্তু দেশে বর্তমানে এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে চলছে ভয়াবহ ভেজালের ছড়াছড়ি। পুরাতন পোড়া মবিল প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল লুব্রিকেন্ট। যেগুলো দামে সস্তা ও লাভজনক হওয়ায় অনেক দোকানি ধুমধাম করে বিক্রি করছেন। ফলে প্রতিদিনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ গাড়ি মালিকরা, আর নষ্ট হচ্ছে গাড়ির মূল্যবান ইঞ্জিন যন্ত্রাংশ।
সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) সম্প্রতি এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সংস্থার মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম বলেন, রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ও ভেজাল লুব্রিকেন্ট জব্দ করা হয়েছে। গাড়িতে ব্যবহৃত লুব্রিকেন্টগুলো পুনরায় নানা উপায়ে রঙ পাল্টে, মোড়ক লাগিয়ে আসল লুব্রিকেন্ট হিসেবে বাজারে ছাড়ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ইঞ্জিনের ভেতরের স্পেয়ার পার্টস অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামেও রয়েছে নকল লুব্রিকেন্ট তৈরির গোপন কারখানা। বিএসটিআই এখন এসব কারখানার সন্ধানে তৎপর হয়েছে। বিশেষ করে সীতাকুন্ড এলাকা ও শহরের কিছু অংশে এসব কারখানা সক্রিয় রয়েছে। এসব কারখানাগুলো নামি ব্র্যান্ডের বোতলে ভরে নকল পণ্য বাজারজাত করছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ভেজাল ও আসল পণ্য আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।
সূত্র মতে, দেশের বাজারে বর্তমানে যেসব লুব্রিকেন্ট বিক্রি হচ্ছে, তার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই ভেজাল। এগুলোর উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে পোড়া মবিল, কেরোসিন, পোড়া টায়ার, প্লাস্টিকের দানা ও বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান। এসব রাসায়নিক ইঞ্জিনের ভেতরের অংশে জমে মারাত্মক ক্ষতি করছে এবং কখনো কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকা (চকবাজার, ইসলামপুর, ধোলাইখাল, চাঁনখারপুল, লালবাগ, তাঁতীবাজার) এবং চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় ছোট ছোট ঘরে চলছে এই লুব্রিকেন্ট প্রক্রিয়াজাতের কাজ। একেকটা দোকানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে একই পণ্য। যেখানে একজন বিক্রেতা একটি লুব্রিকেন্ট বিক্রি করছেন ৬০০ টাকায়, ঠিক পাশের দোকানে একই পণ্য বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। অনেক সময় জেনে-বুঝেই প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা।ক্যাব সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, লুব্রিকেন্ট বা ইঞ্জিন অয়েলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে ভেজাল মেশানো সরাসরি জনস্বার্থবিরোধী কাজ। এতে শুধু গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয় না, রাস্তায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে। বাজারে যে হারে ভেজাল লুব্রিকেন্ট ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এখনই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পুরো সরবরাহ চেইন, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত তদারকির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, সাধারণ ক্রেতারা যেহেতু আসল ও নকল পণ্যের পার্থক্য বুঝতে পারেন না। তাই ব্র্যান্ডগুলোরও উচিত ভেজাল প্রতিরোধে সক্রিয় ভ‚মিকা নেওয়া এবং ভোক্তাদের সচেতন করতে উদ্যোগী হওয়া। একইসাথে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তেলের রঙ, ঘনত্ব ও গন্ধ পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ভেজাল পণ্যগুলোকে আসল বলেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। দেখা গেছে, মোটরসাইকেল গ্যারেজ, গাড়ির ওয়ার্কশপ, এমনকি খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান ও মুদির দোকানেও মিলছে এসব পণ্য। প্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ায় তারা অনেক সময় এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক ফেরদৌস আলম বলেন, আমরা এখন আরও কঠোর হচ্ছি। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিয়মিত অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানহীন লুব্রিকেন্টের বিরুদ্ধে শুধু অভিযান নয়, জনসচেতনতা বাড়ানো এবং প্রতিটি ব্র্যান্ডের অরিজিনাল প্রোডাক্ট যাচাই করার প্রযুক্তি থাকা উচিত। কিউআর কোড স্ক্যানিং বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতারা যেন পণ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।