ধার্মিকতার লেবাসকে পুঁজি করে ‘স্বার্থ সিদ্ধি’

1

লায়ন মোঃ আবু ছালেহ্

ধর্ম কোনো পণ্য নয়, ধর্মীয় কাজ কোনো পেশা নয়। ধর্মীয় কাজ মানুষ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য, এর বিনিময়ও গ্রহণ করবে আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর সকল নবী-রসুল, অবতার, মহামানবগণও এই কথা ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় আল্লাহর কাছে। সুতরাং তাঁদের উম্মতের জন্যও একই বিধান। কিন্তু তা না করে প্রতিটি ধর্মীয় স¤প্রদায়ের মধ্যে একটি বড় জনগোষ্ঠী কিছু ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ব করে সেটাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্থিব স্বার্থ হাসিল করে থাকে। এই পার্থিব স্বার্থের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতাও আসে, ভক্ত মুরিদকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দেওয়ার নাম করে উপঢৌকন নেওয়াও আসে। যখনই এসব পার্থিব স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় তখনই ধর্মে প্রবেশ করে বিকৃতি। অনেক কিছুই তারা বাণিজ্যিক স্বার্থে অতিরঞ্জন করেন, নিজেদের স্বার্থ বিরোধী যা কিছু থাকে তা গোপন করেন। যেহেতু তাদের ধর্মীয় কিছু জ্ঞান থাকে তারা যা বলেন মানুষ সেটাকে আল্লাহ-রসুলের কথা বলে গ্রহণ করে নেয়। তারা যখন কাউকে কাফের ফতোয়া দেয়, মানুষ ঐ ব্যক্তিকে (যাকে কাফের বলা হলো) ঘৃণা করে। এই ধর্মব্যবসায়ীরা আল্লাহর শত্রæ, কারণ এরা আল্লাহর প্রেরিত সত্যকে বিকৃত করে, পার্থিব স্বার্থে ব্যবহার করে। পবিত্র কোর’আনে এবং হাদিসে ধর্মব্যবসার সবগুলি ধরন সম্পর্কেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ধর্মকে বিক্রি করে পার্থিব সুযোগ সুবিধা, সম্পদ হাসিলের কোনো সুযোগ আল্লাহ রাখেন নি। তিনি একে কেবল হারামই করেন নি, তিনি বলেছেন, তারা পথভ্রষ্ট, তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না। তিনি আখেরাতে তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। যাদের গন্তব্য জাহান্নাম, তাদের অনুসারীরাও জাহান্নামেই যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, তোমরা তাদের অনুসরণ করো যারা বিনিময় গ্রহণ করে না এবং সঠিক পথে আছে (সুরা ইয়াসীন ২১)। এই যে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি, তারা কিন্তু এই সত্য বিষয়গুলি কখনো মানুষের সামনে প্রকাশ করে না। তারা সুদ, ঘুষের বিরুদ্ধে বয়ান করেন কিন্তু ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। এ প্রসঙ্গটি তারা গোপন রাখতে চান। তাদের একটি শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগায়। তারা নিজেদেরকে ইসলামের ধারক হিসাবে প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধপক্ষকে ইসলামবিদ্বেষী হিসাবে ফতোয়া দেন। জনগণও তাদের কথায় প্রভাবিত হয়। কিন্তু এই শ্রেণিটি যে স্বার্থের হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করছে এবং তারা নিজেরাই যে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ সেটা যখন প্রকাশ করে দেওয়া হবে তখন জনগণ তাদেরকে ধিক্কার দেবে। জনগণ যখন বুঝতে পারবে আল্লাহ তাদেরকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন এবং তাদেরকে অনুসরণ করলে জাহান্নামে যেতে হবে তখন জনগণও আর তাদের ডাকে সাড়া দেবে না। এভাবেই আমাদের দেশ থেকে, পৃথিবী থেকে ধর্মের নামে দাঙ্গা, ধর্মের নামে অপরাজনীতি, প্রতিহিংসা, সহিংসতা, ক্ষমতার জন্য, ব্যক্তিগত দলীয় স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ হবে। মানুষের জীবন যেমন নিরাপদ হবে তেমনি তারা সুপথও পাবে। ইসলামে ধর্মব্যবসায়ীদের কোনো স্থান নেই, যে সমাজে তাদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় সেই সমাজেও তারা অশান্তি বিস্তার করে।
একথায় কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে চলছে জমজমাট ধর্ম ব্যবসা। ধর্মকে পুজি করে চলছে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল, অন্যায় ভাবে মানুষের অর্থ লোপাট এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। কিন্তু একদল ধর্মের জ্ঞান হীন, পরজীবী ও চরম ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ‘ধর্ম ব্যবসা’ কে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত না করে অদ্ভুতভাবে প্রকৃত ইসলাম প্রচারক এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাঝে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। তাই ধর্ম ব্যবসার সঠিক পরিচয় এবং আমাদের সমাজে ধর্মব্যবসার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা হলো।
ধর্ম নয় অথচ ধর্মের নাম দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে অর্থ উপার্জন ও স্বার্থ সিদ্ধি করাকেই ‘ধর্ম ব্যবসা’ বলা হয়। ধর্ম ব্যবসায়িরা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অজ্ঞতা ও আবেগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় ও স্বার্থ হাসিল করে। এরা টাকা-পয়সা, পদ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা লাভের বিনিময়ে হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল, ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। কখনো সত্যকে গোপন বা বিকৃত করে। এভাবে তারা ধর্মের ছদ্দাবরণে ধর্মীয় লেবাসে তাদের ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যায়।
এমন ধর্ম ব্যবসা সবচেয়ে বেশি ছিলো ইহুদি-খৃষ্টান ধর্ম জাযকদের মধ্যে। তারা অর্থের বিনিময়ে আল্লাহর কিতাব তওরাতকে বিকৃত করতো এবং তার অপব্যাখ্যা করে টুপাইস কমিয়ে নিতো। মহান আল্লাহ ইহুদি-খৃষ্টান ধর্ম জাযকদের এই অপকর্মের মুখোশ উম্মোচন করেছেন কুরআনের বিভিন্ন স্থানে। নি¤েœ কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল :
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আল্লাহ যখন আহলে কিতাব (ইহুদি-খৃষ্টান) দের কাছ থেকে অঙ্গিকার গ্রহণ করলেন যে, তা মানুষের নিকট বর্ণনা করবে এবং গোপন করবে না, তখন তারা সে প্রতিজ্ঞাকে নিজেদের পেছনে ফেলে রাখল আর তার কেনা-বেচা করল সামান্য মূল্যের বিনিময়ে। সুতরাং কত নিকৃষ্ট তাদের এ ব্যবসা।” [সূরা আলে ইমরান: ১৮৭]
তিনি আরও বলেন, “নিশ্চয় যারা সেসব বিষয় গোপন করে, যা আল্লাহ কিতাবে নাজিল করেছেন এবং সেজন্য অল্প মূল্য গ্রহণ করে তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই ঢুকায় না। আর আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদের সাথে না কথা বলবেন, না তাদেরকে পবিত্র করবেন। বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” [বাকারা: ১৭৪]
তিনি আরও বলেন, ”অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা বাকারা: ৭৯]
দুর্ভাগ্য বশত: মুসলিমদের মাঝেও বড় বড় দাড়ি, পাগড়ি, টুপি, জুব্বা-আলখেল্লা ও ভালমানুষীর আড়ালেও চলে এমন মারাত্মক ধর্ম ব্যবসা ও ধোকাবাজি।
এক শ্রেণীর মানুষ নির্বাচনের আগে মাথায় টুপি পড়ে, হাতে তাসবিহ নিয়ে জায়নামাজে বসে বা দু হাত তুলে মুনাজাতের ভঙ্গিতে পাক্কা মুসল্লি সেজে দেয়ালে দেয়ালে ছবি পোস্টারিং করে, টুপি-পাঞ্জাবী পরে ধার্মিক সাজে, ভোটের আগে মসজিদ-মাহফিলে টাকা-পয়সা দান করে দীনের একনিষ্ঠ খাদেমের রূপ ধারণ করে কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরেই তাদের মুখোশ খুলে যায়। এই মুখোশধারী কপট লোকগুলোই একটু সুযোগ পেলেই দীন ইসলাম ও দীনদার মানুষদেরকে নানাভাবে অপমানিত ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং ইসলামি আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরাই হল, রাজনৈতিক ধর্ম ব্যবসায়ী ও ধোঁকাবাজ আরেক শ্রেণির মানুষ কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” ব্যবহার করে কিন্তু ‘বিসমিল্লাহ’র সম্মান রক্ষা করে না, ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করে না বরং তা কেবল জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ভোট হাসিলের উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। এরাও ধর্ম ব্যবসায়ী ও প্রতারক। কারণ এরা তাদের নিজস্ব স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে-যেভাবে একসময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতো নিজেদের গদি ধরে রাখার স্বার্থে।
তথাকথিত চেতনা ব্যবসাও অনুরূপ একটি বিষয়। চেতনার মুখোশ পরেই এই স্বার্থান্বেষীরা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি, অর্থ উপার্জন ও ক্ষমতার মসনদটা ধরে রাখে।
আমাদের সমাজে কিছু লোক মাজারের নাম দিয়ে ও ভন্ড পীরের নাম দিয়ে মূলত অজ্ঞ লোকদের নিকট থেকে সুকৌশলে অর্থ উপার্জনের একেকটি ফাঁদ ও ধর্ম ব্যবসার কেন্দ্র করে। এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা নানা ছলে-বলে, কলা-কৌশলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত বিশাল অংকের অর্থ-কড়ি কামিয়ে নিচ্ছে।
মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানার ফান্ড আত্মসাৎ করা হল, এক নিকৃষ্ট ধর্ম ব্যবসার নাম। এই চোর প্রতারক গোষ্ঠী ধর্মীয় কাজের নামে মানুষের দান-সদকা আত্মসাত করে।
যে সব বক্তারা জনপ্রিয়তা অর্জন বা ওয়াজের মার্কেট ধরার স্বার্থে সত্যের সাথে মিথ্যার ও হকের সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটায়, সত্য গোপন করে এবং ‘যেখানে যেমন সেখানে তেমন’ নীতি ধারণ করে ওয়াজ করে তারাও ধর্ম ব্যবসায়ী ও প্রতারক।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমি (নূহ আলাইহিস সালাম) তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো সৃষ্টিকুলের রবের কাছেই আছে।” [সুরা শু’য়ারা – ১০৯]
পরিশেষে দুআ করি, মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে ইসলাম প্রচার-প্রসার করার পাশাপাশি ইসলামের নামে ধর্ম ব্যবসায়ীদেরকে চিহ্নিত করার তওফিক দান করুন এবং সত্যিকার আলেমদেরকে সব ধরনের শয়তানি ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক