ধর্ষণ প্রতিরোধে চাই পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা

1

এমরান চৌধুরী

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আমার মনে হয় এই সর্বোচ্চ সাজার কথা এদেশের প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মানুষের অজানা থাকার কথা নয়। জানার পরও কেন যে তারা ধর্ষণের মতো জগণ্য কাজে লিপ্ত হয় তা গভীর চিন্তার বিষয়। কয়েক মিনিটের ভালোলাগা কী যমের কথা ভুলিয়ে দিতে পারে? যদি পারে তা ভাবনার বিষয়। সাধারণ চোখে মানুষ মনে করে বিচার ব্যবস্থার লম্বা লাইন, অনৈতিক উপায়ে বিচারকে প্রভাবিত করার প্রয়াস, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য, টাকার জোরে বা ভয় দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করার সুযোগ থাকায় ধর্ষক অপরাধ করেও অনেক সময় পার পেয়ে যায়। এ প্রবণতা থেকেই ধর্ষক জগণ্যতম কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার পরিবর্তে নতুন করে সাহস পায়।
এই গেলো সাধারণ চোখের ভাবনা। আসলে এ জগণ্য মনোবৃত্তির প্রধানতম কারণ মানসিক বিকৃতি। এমন অনেক লোক আছে ঘরে সুন্দরী বউ থাকার পরও পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। আর পরকীয়ার মহিলাটি যদি কৃষ্ণতিথির মতো কিংবা রান্না করা হাঁড়িপাতিলের তলার ঝুলের মতো হয় কালোও হয়, পরকীয়াসক্ত ব্যক্তির কাছে তা হুরের সমান। এটা নিঃসন্দেহে মানসিক বিকৃতি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দেওয়ান আবদুর রহিম-এর মতে ‘সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কখনো রেপ করে না। এটা অবশ্যই সাইকোলজিক্যাল ডিস অর্ডার এবং যে ধর্ষণ করে সে নিঃসন্দেহে একজন মেন্টাল পেশেন্ট। তবে এ ধরনের রোগীকে সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনা সহজ নয়।’ এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর কামালউদ্দিন। তাঁর মতে ‘মানুষের জন্ম থেকে বড় হওয়া, থাকার পরিবেশ, তার সঙ্গী কেমন, মাদক গ্রহণসহ অনেক কারণে এই অসুস্থতা বা বিকৃতি তৈরি হয়।(সূত্র : দেশ রূপান্তর)
অন্যদিকে জন্মগতভাবে মানুষ কিছু ভালো গুণের যেমন অধিকারী হয়, তেমনি খারাপ গুণেরও অধিকারী হতে পারে। আপনার পরিবারের কেউ যদি ধর্ষণের মতো কুকর্ম করে থাকে তা ছোঁয়াচে রোগের মতো পরবর্তী জেনারেশনে সংক্রমিত হতে পারে। অর্থাৎ তা আপনার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কারও না কারও চরিত্রে দেখা দিতে পারে। এভাবে ধর্ষকের পরিবারে ধর্ষক জন্ম নিতে পারে। ফলে একটু একটু করে সমাজের আলোকিত দিক অন্ধকারে ঢেকে যায়।
ধর্ষকের পরিবারে ধর্ষকের জন্মের সবচেয়ে বড় উদাহরণ, সা¤প্রতিককালের সাড়া জাগানো ধর্ষণের ঘটনা। প্রশ্ন উঠতে পারে হিটু শেখ কি ধর্ষক ছিল? তা এ মুহূর্তে প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য না থাকলেও বাপের মানসিক বিকৃতি পুত্র-কে পেয়ে বসাই যথেষ্ট অর্থবহ। যদি ভুলে না গিয়ে থাকেন স¤প্রতি দেশ জুড়ে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনার এই দুজন নায়ক। একজন পিতা ( হিটু শেখ), অন্যজন তার সদ্য বিবাহিত পুত্র ( সজীব হোসেন)। পিতা ( তালই), পুত্র ( দুলা ভাই)-এর কাছে ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের মাসুম শিশু আছিয়া। ধর্ষক হিটু শেখ-কে যদি ঠিকমতো জেরা করে তার অতীতের কুকর্মের বিষয় জানতে চাওয়া হয় তাহলে এরকম কিছু তথ্য বেরিয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়।
অন্যদিকে গৃহকর্তা বা গৃহকর্তার ছেলে কর্তৃক গৃহকর্মীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বলাই বাহুল্য। লোকচক্ষুর আড়ালে এরকম ঘটনা অবিরাম ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু পিঠ দেয়ালে না ঠেকলে এসব ঘটনা খুব একটা প্রকাশিত হয় না। না হওয়ার পেছনে রয়েছে গৃহকর্মীর দুর্বল পারিবারিক অবস্থান এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর সব দেশে বিত্তশালীদের পরিবারে যে গৃহকর্মী থাকে তার কতজন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের লালসামুক্তভাবে কাজ করে যেতে পারে তা গবেষণা ছাড়া নির্ণয় করা কঠিন।
বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমান হারে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অবাধ প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। আজকাল ১০/১২ বছরের শিশুদের হাতে শোভা পায় দামি ডিভাইস। ৮/১০ হাজার টাকা মজুরি/ বেতনের চাকুরি করা ছেলেমেয়েদের হাতে দামি দামি মোবাইল ফোন। যে ডিভাইসে টিপ দিলে হুট করে চোখে পড়ে সুড়সুড়ি দেওয়া বিভিন্ন উপাদান। অনলাইনে পর্ণোসাইটে ঢুকতে কিছু বিধি নিষেধ থাকলেও জঊঊখঝ দেখতে নেই কোনো বাঁধা। এই জঊঊখঝ একটা বøæ ফিল্মের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এছাড়া ফেসবুকে এমন কিছু আইডি থাকে যা যৌনতায় পূর্ণ। থাকে কলগার্লদের খোলামেলা আইডি । ফলে তরুণীর পাশাপাশি মাসুম শিশুরা যেভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তা ভাবতেই বড় কষ্ট হয়। ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মানুষ দূরে সরে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বাবা-চাচার কাছেও আজ কেউ নিরাপদ নয়।
এখন সময় এসেছে ধর্ষণের মতো সংক্রামক ব্যাধি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করার। বর্তমানে ধর্ষণ এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে পারিবারিক ও সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এটিকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কমবেশি দায়িত্ব রয়েছে। মা-বাবাকে শিশুর চলাফেরার প্রতি সযত্ন নজর রাখতে হবে। স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের দামি ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক করতে হবে। সন্তান যদি ইভটিজিং এর মতো কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তা পুনরাবৃত্তিরোধে কঠোর হতে হবে। বাড়িতে মেহমান আসলে সে মেহমান যদি পুরুষ হয় তাহলে আপনার চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। একইভাবে মেয়ে হলেও আরও বেশি সতর্কতা জরুরি। বলা তো যায় না আপনার সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেটি বা মেয়েটি কখন কার ফাঁদে পড়ে। সমাজের সর্দার তথা ওয়ার্ড মেম্বারদের তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বখাটেদের তদারকির কাজে লাগানো যেতে পারে। কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে কিংবা ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু বা আত্মহত্যা সংঘটিত হলে সরকারকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ ধরণের ঘটনায় সরকারকেই বাদী হয়ে মামলা পরিচালনা করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স¤প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের দ্রুত বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠন করতে যাচ্ছে। এটি শিশুদের প্রতি যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
মনে রাখতে হবে এ দেশের মানুষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় নিজেদের ইজ্জত-সম্মানকে। আগুনে পুড়ে সর্বশ্রান্ত হলে তা পুনরায় ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, ফকিরনি অবস্থা থেকে বড় লোক হওয়া খুব একটা অসম্ভব নয়। কিন্তু নিজেদের ঘরে যদি কেউ ধর্ষিতা হয় তখন সমাজ যতই দিলখোলা হোক, তখন ধর্ষিতা তো বটেই পরিবারের কোনো সদস্যের মুখ দেখাবার জায়গা থাকে না।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক