মিঞা জামশেদ উদ্দীন
হঠাৎ আঙ্গিনায় দুর্লভ প্রজাতির একটি পাখির দেখা মিলে; পাখিটা উড়ে এসে মাটিতে বারবার ঠোকর দিয়ে কিসব খোঁজে বা ধরতে চেষ্টা করছিল। সম্ভব পোকামাকড় জাতীয় কিছু একটা হবে। পোকামাকড় যে তাদের খাবার হতে পারে; একথা কমবেশ সকলের কাছে জানা আছে। তবে প্রজন্মদের কাছে তা ক্ষানিকটা খটকা লাগতেই পারে; তারাতো সময়ের সাথে অনেককিছুকে গুলিয়ে ফেলছে; দেখা যায় বেশিরভাগ তরুণ-যুবক মোবাইল আসক্তিতে ভুগছে। তারা এসব জাগতিক ভাবনা-চিন্তা থেকে যোজন যোজন মাইল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মুলত আমাদের আঙ্গিনা ঝোপঝাড়, লতাপাতা ও তৃণলতায় ভরা। হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখা হয় না; সোজাসাপটা উত্তর, আগের মতো তেমন একটা পরিষ্কার রাখার প্রয়োজন পড়ছে না; তার কারণ হলো, এখন তো পরিবারের চাষাবাদের সাথে জড়িত কেউ নেই, বাবা-মা যতদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত কৃষি-চাষবাদ করা হয়েছে। ফলে ফসল শুকানো বা মাড়ানোর জন্য আঙ্গিনা নিয়মিতভাবে পরিস্কার রাখা প্রয়োজন পড়তো। এখন নিজেদের অজান্তে ক্রমাগত ঝোপঝাড়, পোকামাকড় ও ঘাসফড়িংয়ের দখলে চলে গেলে; পাখিরাও ক্ষণে ক্ষণে উড়ে এসে আহারে মেতে থাকে আঙ্গিনায়। এতক্ষণ যে পাখি নিয়ে গালগল্প করা হচ্ছিল, নেহাৎ এ পাখি দেখতে সাধারণ কোনো পাখির মতো মনে হয়নি; আকারে ছোটখাটো ঘুঘু পাখির মতো।
বিশেষ করে ডানা তার দোরাকাটা-দোরাকাটা, যেন পল্লি কবি জসিম উদীনের নকশিকাঁথার মাঠ। মাথায় তার লম্বা জুটি, দীর্ঘ ঠোঁট ও মার্বেলের মতো গোলাকার চোখ। অসময়ে পাখিটি দেখে ভীষণভাবে মুগ্ধ হই এবং ভাবনায় নিমজ্জিত। এরমধ্যে মোবাইলেও ভিডিও-ক্লিপ ধারণের চেষ্টা; না, ভালো ভিডিও-ক্লিপ আসচ্ছে না; এবার ঢালে উড়ে বসে পাখিটি। আবারও একটি ভিডিও-ক্লিপ ধারণা করতে চেষ্টা। হ্যাঁ, এবার কিছুটা ভালো হয়। পাখিটি পরপর আরো দুইদিন আঙ্গিনায় দেখাযায়। সে যথানিয়মে মাটিতে ঠোকাচ্ছে এবং আহার আহরণে ভীষণভাবে মগ্ন থাকতে দেখাযায়। আবারও কাছে থেকে এয়েকটি স্থির ছবি ও ভিডিও-ক্লিপ ধারণ করার সুযোগ হয়। তবে এ পাখিটি দেখতে কাঠঠোকরা প্রজাতির পাখির মতো। কিন্তু কাঠঠোকরা তো গাছের কুঠুরি ও চাল-বাগল ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে পোকামাকড় ধরে আহার করে থাকে, কিন্তু এভাবে মাটি খোড়াখুঁড়ি করতে কখনো দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে তাদের খাদ্যাভাব তীব্রতর।
কবি ও প্রফেসর হোসাইন কবির-এর পাখি বিষয়ক একটি কবি আছে। কবিতাটি সারাংশ হলো, নগরায়নের নামে ক্রমাগত বনজঙ্গল-গাছপালা উজার হচ্ছে, এবং সমানে কর্তন করা হচ্ছে পাহাড়ও। দখল করা হচ্ছে জলাশয় ও নদী। এতে করে জীববৈচিত্র্য রক্ষা বা পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে। এরমধ্যে ৬-৩-’২৫ইং দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রথম পৃ. একটি নিউজ ও একটি ফটো দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা হয়। প্রায় ৬৯৭টি বাবুই-চড়ুই শালিক-পাখির হত্যা করার বীভৎস এ ছবি। রীতিমতো এটি দেখে যে কেউ চমকে উঠবে; প্রথমত ছবিটা এমন দেখাচ্ছিল যে, দেশের মানচিত্র রূপে। অনেকটা তা ধারণা করেছে; যেন পুরনো শকুন খামচে ধরেছে। অবয়বে এমন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এভাবে কি আমাদের দেশ-জাতি, সমাজ ও প্রকৃতি-পরিবেশকে নীরবে হত্যা করা হচ্ছে; চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ইছামতি খালের আশপাশের বিল থেকে শিকারীদের ঘেরাটোপে আটকানো হয় এসব পরিবেশ বান্ধব পাখি। তারপর জবাই করে নগরির হোটেল-রেস্তোরাঁয় কবুতর ও কোয়েল পাখি হিসেবে চালিয়ে দেয়া; অবশ্য এ সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তিন শিকারী ছৈয়দুল আলম, মো. ইদ্রিস ও মো. সোহেলকে আটক করা হয়। পত্রিকার ইনসেটে তাদের ছবিও ছাপানো হয়। কথা হলো, তারা কি জানে, এসব কাজকারবারে মহা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে জাতিকে। এসকল পাখি তো পরিবেশ সহায়ক। যেখানে কৃষকেরা অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে ফসলে পোকামাকড়ে উপদ্রবে। কোনভাবেই এর হাত থেকে রক্ষা করতে পাচ্ছেনা ফসলকে। শেষতক অনেকে বিষাক্ত কীটনাশক দিয়ে পোকামাকড় দমন করতে চেষ্টা চালায়। এতে কিন্তু ভালো দিকের চাইতে খারাপের দিকটা হয় বেশি কৃষক ও দেশের। এ বিষযুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল খেয়ে কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে লোকজনকে প্রতিনিয়ত। পাখিরা আমাদের এমন একটি মহা বিপদ থেকে রক্ষা করেই চলেছে অবলিলায়। পাখি শিকার ও পরিবেশ অনিষ্টকারীদের কঠিন হস্তে দমন ও দৃষ্টান্তমূলক দাবি রাখে।
ইদানিং কৃষি জমির ওপর নজর পড়েছে মাটিখেকোদের। রাতে আঁধারে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে-দিবালোকে এলাকায় এলাকায় এ উৎপাত শুরু হয়েছে। দুর্বৃত্তরা স্কেবেটর দিয়ে কৃষি জমির টপ-সয়েল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে কৃষকদের চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে। সাথে স্কেবেট ও ড্রামট্রাক দিয়ে খালের মাটিও নিয়ে যাচ্ছে অস্ত্রধারী এসকল দুর্বৃত্তরা। এ যেন মঘের মুল্লুকের হরিলুট চলছে সমানে। স্থানীয় প্রশাসন অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছেন। এরকম একটি অভিযোগ নিয়ে আসলেন সীতাকুন্ড ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসার রেজাউনুল হক। তিনি সীতাকুন্ড থানায় একটি লেখিত অভিযোগের পাশাপাশি ওসি সাহেবের সাথে দেখা করে সরাসরি এ অভিযোগটি আবারও করেন। অবশ্য ওসি মজিবুর রহমান তাঁর এ অভিযোগ গুরুত্বসহকারে নেন এবং তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। ওইসময় কাকতালীয়ভাবে স্থানীয় এক প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও আমি উপস্থিত ছিলাম সেখানে। আমিও সীতাকুন্ড ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিলাম। রিজওয়ান স্যার আমাদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তিনি ম্যানেজমেন্টের প্রফেসার ছিলেন। অপর বিএনপির নেতা জহুরুল আলম জিহুরও তাঁর আত্মীয় বলে ওসি সাহেবকে জানান তিনি। আমিও বললাম, হ্যাঁ, স্যার আমাদের কলেজে পড়িয়েছেন। একইভাবে অপর একটি অভিযোগ জানালেন শেখেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জসিম উদ্দিন। তিনিও উপজেলা বিএনপির সাবেক নেতা ছিলেন। তিনিও আক্ষেপ করে বলেন, দেশে কি শুরু হয়েছে কে জানে, কেউ কারো কথা শুনছে না। খোদ আমার ভাইপুত না জানিয়ে আমাদের জমি থেকে মাটি বিক্রয় করে দেয়।
তবে এভাবে প্রশাসনের এ নিষ্ক্রিয়তায় কৃষি সেক্টর বড়ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে। একেরপর এক এসব ঘটনায় সমাজের সেইন্ট অফ কমান্ড ভেঙে পড়েছে। হঠাৎ বেড়ে যায় ধর্ষণ ও গণধর্ষণের প্রকোপও। চলতি মার্চ মাসের প্রথমদিকে দেশের সকল পত্রিকার পাতাজুড়ে এসব লোমহর্ষক ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাকেও হার মানিয়ে। এ নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। রীতিমতো জনগণ বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে থাকে। বিশেষ করে মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জনেমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এরমধ্যে কিছু অতিরঞ্জিত ঘটনাও ঘটে চলেছে। সীতাকুন্ডেও একসপ্তাহের মধ্যে দুটি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনা কিছু নাটকীয় বা সাজানো মনে হয়। ক্ষোভের বসতে একে অন্যেকে ফাঁসাতে গিয়ে এ ন্যাক্কারজনক পন্থা অবলম্বন করে। তবে ঘটনা তদন্তের দাবি রাখে। তার সাথে মেডিক্যাল রিপোর্টও থাকতে হবে। তবে এসব ঘটনা দীর্ঘ মেয়াদি সমাজে প্রভাব পড়বে, তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সমাজে বাল্যবিবাহের প্রবণতাও বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কানজক হারে। সঙ্গে নারী শিক্ষারও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক : কবি, গবেপও কলামিস্ট