মো. দিদারুল আলম
দেশে বর্তমানে ধর্ষণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতে এ দেশে বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনা লোকলজ্জা আর সামাজিকতার ভয়ে আড়ালেই থেকে যায়। একটা ধর্ষণেরও যদি প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড বা দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতো তাহলে দেশ থেকে ধর্ষণের ভয়াবহতা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও উল্লেখযোগ্য হারে কমতো। মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে। বোনের স্বামীর সহায়তায় তার বাবা (বোনের শ্বশুর) মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর চিকিৎসারত অবস্থায় আছিয়ার ১৩ মার্চ মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ বর্বরোচিত মৃত্যুতে দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। দেশের মানুষ দ্রুত এর বিচার চায়। এই ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত তিনটি শিশুর ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এ মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আট জনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি। এইচআরএসএসের আরো তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এক হাজার ৮৯ জন নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০৭ জনকে। এর মধ্যে শিশু ১১৮ জন। ৫০ জন ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু আত্মহত্যা করেছে জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত পাঁচ বছরে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দুই হাজার ৬২৪ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯০ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২৬ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন এক হাজার ২৬২ জন, আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৪১৬ জন নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯৪ জন নারী ও কন্যাশিশু, যার মধ্যে মারা গেছে ৯ জন।
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সরকারের প্রতি আহবান, সব জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারীর সাংখ্যিক দিক নয়, বরং কার্যকর ও গুণগত দিক বিবেচনায় নিতে হবে। যেকোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজনে নারীদের অংশগ্রহণ এবং অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সমাজের সব পর্যায়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি সহিংসতার সব বিচার ও আইনি প্রক্রিয়া সহজতর ও দ্রæত করতে হবে। ধর্ষণ ছাড়াও নারীকে হেনস্তা ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পাশাপাশি গণপরিসরে নারীরা নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঘটনা নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা, স্বাধীন চলাচল ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক সময়ই ঘটনার সুষ্ঠু কোনো বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
ধর্ষণের মতো নিন্দনীয় এ ঘটনার পেছনে দায়ী সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, যথাযথ শিক্ষার অভাবসহ মাদকের মতো বেশ কিছু বিষয়। ধর্ষণের মতো ঘটনার বিস্তার রোধে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার কথিত এই ধর্ষকদের। এবং শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে যাতে কেউ এই ধরনের হীন কাজ করার সাহস না দেখায়। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ, বিদ্যালয়ের মতো জায়গাগুলোতে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার করা উচিত। এছাড়া লিফলেট, ব্যানার- পোস্টারের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো উচিত।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী, আমাদের দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদÐ বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড’। এমন কঠোর আইন থাকা সত্তে¡ও রীতিমতো একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে। দিন দিন ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া। এছাড়াও অন্যতম প্রধান কারণটি হলো রাজনৈতিক পরিচয় তথা ক্ষমতার প্রভাব। অপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে অস্ত্র ও শাস্তি ঠেকানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পায়। তারা জানে পুলিশ, আইন, বিচার তথা প্রশাসন সবকিছুই তাদের অপরাধের আশ্রয়স্থল। তারা জানে যে, এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে। তাই তারা অনায়াসে নির্ভয়ে নানা রকম অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাদের কাছের মানুষ দ্বারা। ছেলে ও মেয়েশিশুসহ বিভিন্ন বয়সী নারীর ওপর ধর্ষণের ঘটনা কয়েক দশক ধরে এতই বেড়ে গেছে যে এর প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে মানুষ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মানুষ ধর্ষকের কঠোর শাস্তির দাবি তুললেও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে সেটাই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ, ধর্ষণ একটি অপরাধমূলক আচরণ এবং সেই আচরণের প্রাথমিক ভিত্তি হলো নারীর প্রতি ক্রমান্বয়ে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ও বিকৃত চিন্তা প্রক্রিয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১ টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রæয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রæয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়াকে দায়ী করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকেরা আইনের দুর্বলতার কারণে পার পেয়ে যায়, যা তাদের আরও অপরাধে জড়াতে উৎসাহিত করে।
নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা জরুরি। অতীতের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়। তাই বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া উচিত। নারীরা যেন যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নির্ভয়ে সহায়তা চাইতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রতটি থানায় নারী নির্যাতন সংক্রান্ত আলাদা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যেখানে নারীরা সহজে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং পাশাপাশি ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক