জসিম উদ্দিন মনছুরি
পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়। কট্টরপন্থী মোদি সরকার ভারত থেকে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে এক একটি মুসলিম বিরোধী আইন করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াকফ আইনের সংশোধন করে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, কবরস্থান, মাদ্রাসা ও মসজিদ দখল করার জন্য মোদি সরকার বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিগত কিছুদিন আগে হোলি উৎসবে একজন মুসলমান যুবককে দিন দুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা উত্তরাখন্ডে প্রায় ১৭০ টি মাদ্রাসা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া মসজিদ মাদ্রাসা নির্মূল করার সংবাদ নিত্য ছাউর হচ্ছে। মুসলমানদেরকে ঘরবাড়ি ছাড়া করার লক্ষ্যেই তাদেরকে কোন ওয়ারেন্ট ইস্যু ছাড়া গ্রেফতার করা হচ্ছে। উগ্রবাদী হিন্দুত্ব সংগঠন আরএসএস যা বলে তাই যেন ভারতীয় হাইকোর্টের আইনে পরিণত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানরা যে হারে নির্যাতিত হচ্ছে তা কল্পনাহীন। ভারতে মুসলিম নির্যাতনের খবর নতুন নয়। গুজরাটের কসাইখ্যাত তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদির ইন্দনে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ৩ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। দুই শতেরো অধিক মুসলিম মা-বোনকে ধর্ষণ করা হয়।
১৯৯২ সালে রাম মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মর্মে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে তার উপর রাম মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৭০০ বছর মুসলমানরা ভারতবর্ষ শাসন করলেও কোন হিন্দু ধর্মের উপর কখনো আঘাত করেনি। হিন্দুরা স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করে গেছেন। অথচ যে ভারত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে অহেতুক নাক গলায় সেই ভারতেই মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। ভারতের দাদাগিরির কারণে পার্শ্ববর্তী কোন রাষ্ট্রের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান, চীন, নেপাল ও বাংলাদেশ কোন দেশের সাথে এই মুহূর্তে ভারতের সুসম্পর্ক নেই। ভারত নিজেদের স্বার্থে এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশকে জিম্মি করে রেখেছিলো। বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের তাবেদার হয়ে মোদির নির্দেশই যেন পালন করেছেন। দেশের ক্ষয়ক্ষতি করে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা ও অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে মোদিকে খুশি করার প্রচেষ্টায় ছিলেন। বিনিময়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৬ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতকে তুষ্ট করতে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো। জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পলায়ন করলে বাংলাদেশের সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের বৈরী সম্পর্কের সূচনা হয়। ভারত যাই করুক না কেন শেখ হাসিনা সরকার মাথা নাড়িয়ে হাঁ সূচক সম্মতি দিয়েছিলেন।
প্রতিবাদ করার মতো সাহস কিংবা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার রীতিনীতি শেখ হাসিনার ছিল না। শেখ হাসিনা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের ইশারায় ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে দমন পীড়নের আশ্রয় নিয়েছিল শুধুমাত্র ভারতকে খুশি করার জন্য। অথচ বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে সংগঠিত হয়ে থাকতে পারে। ইসরাইলের পরম মিত্র ভারত ইসরাইলের প্রেসক্রিপশনে মুসলমানদেরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করে হিন্দধর্ম ও অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইসরাইল যেমন নিজ ভূমি থেকে ফিলিস্তিনীদেরকে বিতাড়িত করে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইসরাইলিদের ভারত সমরাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে বলে কথিত আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের বর্বরতম হত্যাকান্ডে পৃথিবীবাসী সোচ্চার হলেও ভারতীয়রা ইসরাইলের পতাকা নিয়ে ইসরাইলের মুসলিম হত্যাকান্ডকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করে যাচ্ছে। ভারতও ইসরাইলি নীতি অবলম্বন করে হয়তো মুসলমানদেরকে নিধন করার উদ্দেশ্যে কিংবা দেশ ছাড়া করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন তৈরি করেই অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস বহু আগে থেকে ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, আফগানিস্তানের কিছু অংশ ও বাংলাদেশকে নিয়ে হিন্দুধর্ম ও অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা। বিশ্লেষকদের মতে মোদি সরকার মুসলমানদের উপর যেভাবে নির্যাতন শুরু করে দিয়েছে তা হিন্দুধর্ম ও অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা কিনা সন্দেহ বা সংশয় রয়েছে। ভারতের প্রতিটি রাজ্যে মুসলমানদেরকে নির্যাতনের খবর প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। আসামে মুসলমানদেরকে উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা নির্মমভাবে নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। ভারত জুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুরা তাদের উপর নির্যাতনের জন্য ফুঁসে উঠেছে। এ অবস্থায় মোদি সরকার নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় পুলিশ বলেছে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ভারতীয় পুলিশ আর নিতে পারবে না। এ থেকে বুঝা যায় মোদি সরকার ও উগ্রবাদী আরএসএস মিলে সব রকমের প্রচেষ্টায় মুসলমানদেরকে ঘরবাড়ি ছাড়া করছে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ-মাদ্রাসা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ওয়াকফ এস্টেট আইন সংশোধন করে মুসলমানদের জায়গা-জমি, কবরস্থান ও মসজিদ দখলে নেওয়া শুরু করেছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। যেই ভারত সব সময় হিন্দু সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে সেই ভারতই সবচেয়ে বেশি মুসলিম নির্যাতিত হচ্ছে। এমনকি জীবন্ত মুসলমানদেরকে পর্যন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করছে। মুসলিম ঐতিহ্যগুলি ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। বিখ্যাত সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতী রাহমাতুল্লাহ এর মাজারের নিচেও হিন্দু মন্দির পাওয়া গেছে মর্মে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হয়তো পরবর্তী টার্গেট খাজা মইনুদ্দিন চিশতী রাহমাতুল্লাহ এর মাজার ভাঙ্গার প্রক্রিয়া কিনা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। একটার পর একটা মুসলিম স্থাপনা ভেঙ্গে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানি ঐতিহ্য নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় মদদে হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র পরিকল্পনায় মুসলমান নিধনের প্রক্রিয়া শুরু করছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এই নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিলেও নিপীড়িত নির্যাতিত হিসেবে তারা প্রতিনিয়ত ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। ভারতীয় পার্লামেন্টেও এ নিয়ে মুসলমানরা কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখালেও তাদের কথায় কর্ণপাত করছে না মোদি সরকার। চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে যে, আরএসএস যা বলে তাই হয়তো হাইকোর্টও বলে থাকে। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মোদি সরকার কি আইন আদালত ও প্রশাসনকে একত্রিত করে মুসলমানদেরকে সর্বহারা করার পরিকল্পনা করছে কিনা? যেভাবে মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে হয়তো মুসলমানরা উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। তখন মোদি সরকারের হিন্দুধর্ম ও অভিন্ন রাষ্ট্র পরিকল্পনা সার্থক হবে। ভারত সম্প্রীতির কথা বললেও পৃথিবীর ইতিহাসেই ভারতই হচ্ছে জঘন্য সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়। দিন দুপুরে পর্যন্ত মুসলিম নারীদের হেনস্থা করা হয়। এমনকি বাধ্য করে শ্রীরাম বলাতে। তাদের উৎসবে মুসলমানদেরকে শামিল হওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকলের সম অধিকার থাকলেও ভারতের কথিত গণতন্ত্রে মুসলমানেরা এখন সবচেয়ে অনিরাপদভাবে বসবাস করছে। ইসরাইলের পরম মিত্র ভারতের অনেক সৈন্য ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রয়েছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইসরাইলের নীতি অবলম্বন করে হয়তো মুসলমানদেরকে তাদের নিজ বসতবাড়ি হতে বিতাড়িত করে সেগুলো দখল করে হিন্দুধর্ম ও অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইহুদিদের নীতিতে ভারতীয় উগ্রবাদী হিন্দুরা অগ্রসর হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। বিশ্বের প্রায় ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্র থাকলেও ক্ষমতা ও বিলাসিতার কারণে আজ মুসলমানরা উদভ্রান্ত। তা না হলে মুসলিম বীরের জাতি হওয়া সত্বেও তাঁরা নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে বিশ্বের চারদিকে চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান থাকা সত্তে¡ও মুসলমানদের অনৈক্যই আজ তাদের লাঞ্ছিত হবার প্রধান কারণ। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এখন সময় এসেছে রুখে দাঁড়াবার।
প্রতিবাদ করার। একতাবদ্ধ হয়ে মুসলমানরা যদি ইহুদিদের রুখে না দাঁড়ায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো ফিলিস্তিনের পরিণতি ভোগতে হতে পারে ভারতীয় মুসলমানদের। এখনই সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতীয় জঘন্য নীতিকে কঠিন ভাবে প্রতিহত করে নিজেদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার। আন্তর্জাতিক মহলের প্রয়োজন ভারতকে তাদের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে বয়কট করা। ভারত এতদিন ধরে বাংলাদেশের উপর দাদাগিরি করে আসলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।
বাংলাদেশও হাসিনার প্রভু মুদির অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে ভারতকে প্রভু মানছে না। নেপাল, চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সবাই আজ ভারতীয় আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ভূ রাজনীতিতে ভারত এখন বন্ধু হারা হয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। এ অবস্থায় প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে ভারতকে বয়কট করা এবং ভারতের মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা।
লেখক : প্রাবন্ধিক