সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
(আল্লাহ, রাসূল ﷺ, কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত, সাহাবা ও মুমিনদের নিয়ে উপহাসÑএকটি স্পষ্ট কুফরি)
ভ‚মিকা :
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার প্রতিটি বিধান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। এই দ্বীনকে সম্মান করা ঈমানের অপরিহার্য দাবি। কিন্তু আজকের সমাজে এক গভীর উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে-আল্লাহ, রাসূল ﷺ, কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত, সাহাবা ও দ্বীনদারদের নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা যেন বিনোদনের উপকরণে পরিণত হয়েছে। কেউ তা করে কথার ছলে, কেউ করে হাস্যরসের মাধ্যমে, আবার কেউ করে সামাজিক মাধ্যমে ‘মজা’ হিসেবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই ‘মজা’ মোটেও নির্দোষ নয়-বরং এটি ঈমান ধ্বংসকারী ভয়াবহ কুফরি কাজ।
উপহাস ও ঠাট্টা : উপহাস, ঠাট্টা বা বিদ্রুপ এমন আচরণ যা অন্যকে হেয়, তুচ্ছ বা অবজ্ঞা করে প্রকাশ করা হয়-মুখের কথা, অঙ্গভঙ্গি বা হাস্যরসের মাধ্যমে। ইসলামী দৃষ্টিকোণে এটি শুধু সামাজিক অসভ্যতা নয়, বরং একটি গুরুতর গুনাহ। বিশেষ করে যখন তা আল্লাহ, রাসূল ﷺ, কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত, সাহাবা বা দ্বীনদারদের প্রতি হয়, তখন তা স্পষ্টভাবে ঈমান ধ্বংসকারী কুফরি কাজ হিসেবে গণ্য হয়।
দ্বীন নিয়ে উপহাসের অন্তর্নিহিত কারণসমূহ : দ্বীন নিয়ে উপহাস কোনো হালকা বা আকস্মিক আচরণ নয়-বরং এটি অন্তরের বিদ্বেষ, অহংকার, অজ্ঞতা ও বিকৃত চিন্তার ফল। কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি গভীর ও ভয়াবহ কারণ :
মূল কারণগুলো হলো :
দ্বীনের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা যারা আল্লাহর পথকে ঘৃণা করে, তারা দ্বীনদারদেরকে বিদ্রুপ করে নিজেদের বিদ্বেষ প্রকাশ করে।
নেককারদের প্রতি হিংসা সাহাবা ও দ্বীনদারদের পবিত্রতা ও ঈমান তাদের জন্য সহ্য হয় না, তাই তারা ঠাট্টা করে।
লক্ষ্যহীনতা ও হাস্যরসের প্রতি আসক্তি মজা ও বিনোদনের নামে দ্বীনকে অপমান করা আজকের সমাজে একটি ভয়াবহ ব্যাধি।
অহংকার ও আত্মপ্রশস্তি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার কারণে দ্বীনদারদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বিদ্রুপ করা হয়।
অন্ধ অনুকরণ পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করে সত্যকে অস্বীকার করা এবং নবীদের প্রতি বিদ্রুপ করা।
অর্থ ও খ্যাতির লোভ হাস্যরস, জনপ্রিয়তা ও অর্থের লোভ মানুষকে দ্বীন নিয়ে ঠাট্টা করতে বাধ্য করে।
এসব কারণ মানুষকে এমন ভয়াবহ গুনাহে লিপ্ত করে, যা ঈমান ধ্বংস করে দিতে পারে। মুসলমানদের উচিত এসব থেকে আত্মরক্ষা করা এবং দ্বীন ও দ্বীনদারদের সম্মান করা।
কুরআনের আলোকে উপহাসের ভয়াবহতা :
দ্বীন নিয়ে উপহাস করা কোনো সাধারণ ভুল নয়-এটি একটি ভয়াবহ কুফরি কাজ, যা ঈমান ধ্বংস করে দিতে পারে। কুরআন ও সালাফদের বক্তব্যে এর ভয়াবহতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
১. আল্লাহ, রাসূল ﷺ ও কুরআনের আয়াত নিয়ে উপহাস: সরাসরি কুফরি: “বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে?’ অজুহাত দিও না, তোমরা ঈমান আনার পর কুফরী করেছো।” – সূরা আত-তাওবা: ৬৫–৬৬
এই আয়াত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ, কুরআনের আয়াত বা রাসূল ﷺ-কে নিয়ে উপহাস করা ঈমান নষ্ট করে দেয়- যদিও তা মজার ছলে করা হয়।
২. মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য: মুমিনদের নিয়ে উপহাস: “তারা যখন মুমিনদের সঙ্গে দেখা করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন শয়তানদের সঙ্গে একান্তে থাকে, তখন বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা তো কেবল ঠাট্টা করছি।’ আল্লাহ তাদের ঠাট্টার যথাযথ শাস্তি প্রদান করেন।” – সূরা আল-বাকারা: ১৪–১৫
৩. মুসলমানদের একে অপরকে উপহাস করা নিষিদ্ধ: “হে মুমিনগণ! কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস না করে, হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম।” – সূরা আল-হুজুরাত: ১১
এই আয়াত মুসলিম সমাজে পারস্পরিক সম্মান ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। কাউকে তার পোশাক, ভাষা, গাত্রবর্ণ বা সামাজিক অবস্থান দেখে উপহাস করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
৪. মুমিনদের প্রতি উপহাস: মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য: ইসলামে মুমিনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি ঈমানের দাবি। যারা ঈমানদারদের পোশাক, ভাষা, আচরণ বা দ্বীনদার জীবনধারাকে অবজ্ঞা করে, তারা কুরআনের ভাষায় “অপরাধী” হিসেবে চিহ্নিত। “অপরাধীরা ঈমানদারদের নিয়ে হাসাহাসি করত।” – সূরা আল-মুতাফফিফীন: ২৯
উপহাসের ভয়াবহতা ও শাস্তি:
কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা: বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে?’ অজুহাত দিও না, তোমরা ঈমান আনার পর কুফর করেছো। – সূরা আত-তাওবা: ৬৫–৬৬
এই আয়াত দ্বীন নিয়ে উপহাসকে স্পষ্টভাবে কুফরি কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি এমন অপরাধ, যার জন্য কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করা তাকওয়ার পরিচায়ক: “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, তা তার হৃদয়ের তাকওয়ার পরিচায়ক।”- সূরা আল-হজ্জ: ৩২-
আল্লাহর নিদর্শন বলতে বোঝায়-তাঁর বিধান, ইবাদত, প্রতীক, সুন্নাহ, শরীয়াহ, কুরআন, হাদীস, হিজাব, সালাত, রোজা, হজ, কাবা, আজান, দ্বীনদারদের পোশাক ও আচরণÑসবই অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম ইবনু কুদামা (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে গালি দেয় বা উপহাস করে, সে কাফির-হোক সে মজা করে বা সিরিয়াস।”
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, “যে কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীন নিয়ে বিদ্রুপ করে, তা স্পষ্ট কুফরি।”
উপহাসের নানা ধরণ: উপহাস বা ঠাট্টা শুধু মুখের কথা নয়-এটি হতে পারে অঙ্গভঙ্গি, লেখা, চিত্র, বা আচরণের মাধ্যমে। ইসলামে এর প্রতিটি রূপই মারাত্মক অপরাধ, যা মানুষকে ঈমান থেকে বিচ্যুত করে দিতে পারে।
উপহাসের রূপ: ইসলামী দৃষ্টিকোণে আল্লাহ, রাসূলﷺ, কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়াহ, সাহাবা ও মুমিনদের নিয়ে উপহাস করা কোনো সাধারণ ভুল নয়Ñবরং এটি স্পষ্ট কুফরি কাজ, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দিতে পারে।
১. রাসূল ﷺ-এর মর্যাদাকে হেয় করা: যেমন তাঁকে “ডাক পিয়ন”, “রাখাল”, “সাংবাদিক”, “নিরক্ষর”, “বেদুইন”, “অন্ধকার যুগের প্রতীক” হিসেবে চিত্রিত করা এবং তাঁকে অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক করে বলা: “মুসা, ঈসা, মুহাম্মদ, রাম, কৃষ্ণ-সবই এক” বলা।
এসব মন্তব্য শুধু অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং নবুয়তের মর্যাদা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বার্তার প্রতি অবজ্ঞা।
২. উম্মুহাতুল মুমিনীন ও সাহাবাদের প্রতি বিদ্রুপ: সাহাবা ও নবী পত্নীদের শরীর, নাম, বর্ণনা নিয়ে ঠাট্টা। যেমন হযরত খাদিজা (রা.)-কে “বেনামাজী”, “বেরোজাদার”, “বে-পর্দা” বলে অপমান করা । আর সাহাবা ও নবী পরিবারের সদস্যদের প্রতি অবজ্ঞা করা মানে ইসলামের ইতিহাস ও আদর্শকে অবমাননা করা।
৩. হাদীস বিকৃতি ও দ্বীনের বিধান নিয়ে হাস্যরস: হাদীসকে বিকৃত করে “মজার গল্প” বানানো ও দ্বীনের বিধানকে নাটক, কৌতুক বা কার্টুনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।
৪. আকীদা ও আল্লাহর গুণাবলীর প্রতি বিদ্রুপ: আল্লাহকে “ভিখারি” বলা, আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে কৌতুক করা।
৫. শরীয়াহকে “পিছিয়ে পড়া” বা “অমানবিক” বলা: চোরের হাত কাটা বা ব্যভিচারীর রজমকে “অমানবিক” বলা ও শরীয়াহকে “মধ্যযুগীয় আইন” বলে অবজ্ঞা করা।
৬. সালাত নিয়ে ঠাট্টা: “নামায জান্নাতে চাবিকাটি! এটি আমি মানি না” এ কথা বলা।
৭. রোযা: “মুসলমানদের রোযা আর হিন্দুদের পূজা-একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ” বলা।
এ ছাড়াও হিজাবকে “মৃতদের কাফন” বলা। শরীয়াহকে “অযৌক্তিক” বা “অপ্রাসঙ্গিক” বলা। দাড়ি, জুব্বা, টুপি, সালাম, ইবাদতকে হাস্যরসের বিষয় বানানো। ইসলামীভাবে অনুমোদিত বহুবিবাহকে “নারী নির্যাতন” বলা। আওলিয়া কেরামের মাযার যেয়ারতকারীদেরকে “কবরপূজারীরা” বলে বিদ্রুপ করা, ইত্যাদি।
উপহাসকারীদের মুখোমুখি হওয়া মুসলমানের করণীয় :
দ্বীন নিয়ে উপহাসকারীদের মোকাবেলায় মুসলমানের দায়িত্ব হলো-আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সত্যের পথে সাহসের সঙ্গে অটল থাকা এবং দ্বীনের মর্যাদা রক্ষা করা। কুরআন মুসলমানদেরকে দুর্বলতা ও হতাশা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে, “তোমরা দুর্বল হয়ো না, দুঃখ করো না; যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে তোমরাই বিজয়ী।”- সূরা আলে ইমরান: ১৩৯
আল্লাহ বলেন, “তুমি যা আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ করো এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয়ই আমি তোমার জন্য উপহাসকারীদের মোকাবিলা করব।”- সূরা আল-হিজর: ৯৪-৯৫
রাসূল -এর প্রতি উপহাসকারীদেও ভয়াবহ পরিণতি:
রাসূল -কে অবমাননা করা মানে আল্লাহকে অবজ্ঞা করা। ইতিহাসে দেখা যায়-যারা তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপ করেছে, আল্লাহ তাদের অপমানজনকভাবে ধ্বংস করেছেন। কুরাইশ নেতারা তাঁকে “পাগল”, “জাদুকর” বলায় একে একে ধ্বংস হয়েছে। পারস্য সম্রাট কিসরা রাসূল ﷺ-এর চিঠি ছিঁড়ে ফেলায় নিহত ও সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা, ধ্বংস এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তি আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর চিরস্থায়ী গজব।
সতর্কতা: দ্বীন নিয়ে উপহাস করা স্পষ্ট কুফরি – সূরা আত-তাওবা: ৬৫–৬৬। “যে আল্লাহর বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করে, সে আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে।” – সহীহ বুখারী।
উপহাসকারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হারাম: দ্বীন নিয়ে যারা উপহাস করে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা শুধু অনৈতিক নয়-বরং এটি ঈমানের জন্য সরাসরি হুমকি। কুরআন স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে হৃদ্যতা, সহযোগিতা বা ঘনিষ্ঠতা রাখতে। “যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেলাচ্ছলে নিয়েছে, তাদেরকে বন্ধু বানিও না।” – সূরা আল-মায়েদা : ৫৭
সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ: আল্লাহর আয়াত নিয়ে তর্ককারীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া – সূরা আল-আন‘আম: ৬৮। তাদের সঙ্গে বসাও নিষিদ্ধ – সূরা আন-নিসা : ১৪০।
বাস্তবতা ও সতর্কতা – দ্বীন নিয়ে উপহাস: একটি ভয়াবহ ঈমান-সংকট
আজকের সমাজে মিডিয়া, সাহিত্য, নাটক ও বক্তৃতায় দ্বীন ও দ্বীনদারদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ একটি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এটি শুধু সামাজিক অসভ্যতা নয়-বরং ঈমান ধ্বংসকারী ভয়াবহ গুনাহ।
উপসংহার :
দ্বীন নিয়ে উপহাস করা কোনোভাবেই “মজা” বা “শিল্প” নয়। এটি আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছ জ্ঞান করার নামান্তর, যা ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। যারা আল্লাহ, রাসূল ﷺ, কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত, সাহাবা ও মুমিনদের নিয়ে বিদ্রিপ করে, তারা কুরআনের ভাষায় কাফির হিসেবে গণ্য হয়। মুসলমানদের উচিত-এই ভয়াবহ অপরাধ থেকে দূরে থাকা, দ্বীন ও দ্বীনদারদের সম্মান করা এবং সত্যের পথে সাহসের সঙ্গে অটল থাকা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ,
সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ











