রূপম চক্রবর্ত্তী
সকালবেলা অফিসে যাওয়ার পথে মোবাইলে খবর পড়ছিলাম। হঠাৎ চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনার খবর দেখে আমার মন বিচলিত হয়ে উঠল। এই দুর্ঘটনায় মা-বাবা তাদের দুইজন প্রিয় সন্তান হারিয়েছেন। ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামমুখী বাস ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে পিছন থেকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে ১ স্কুল শিক্ষার্থী ও রিকশা চালক নিহত হয়। অপর স্কুল শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। মারা যাওয়া দুই স্কুল শিক্ষার্থী দোহাজারী পাঠশালা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী। নিহত ভাই-বোনের নাম ওয়াকার উদ্দীন আদিল ও ৭ম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে হাবিবা রিজভী, রিকশাচালক রুহুল আমিন। এ ঘটনায় আহত হয়ে আরেক শিক্ষার্থী নবম শ্রেণির ছাত্রী কাজী ফাহমিদা ওয়াশিমা তুশিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আসা করার সুবাদে দোহাজারী আমার খুব পরিচিত এলাকা। সড়কের বেশির ভাগ জায়গা এখন সিএনজি এবং ইঞ্জিনচালিত রিক্সার দখলে। রাস্তায় গতিরোধক না থাকার কারণে বিভিন্ন সময় এখানে দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে অনেক যাত্রী এবং পথচারী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দোহাজারীর দুর্ঘটনার পাশাপাশি বিগত দিনের কিছু সড়ক দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করছি। গত ২০২৪ সালের ০৭ নভেম্বর দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে ফটিকছড়ি যাওয়ার পথে হাটহাজারীতে বাস-সিএনজি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৭ জন নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে ৩ জন। নাজিরহাট হাইওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক আনিসুর রহমান জানান, ৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ৩ জন শিশু, ৩ জন মহিলা ও একজন পুরুষ রয়েছে। তারা একটা পারিবারিক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলো। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে বাসচালক পালিয়ে গেছে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে, বড় ননদ ও ভাসুরের ছেলেসহ প্রবাসীর স্ত্রী রিতার পরিবারের সাত প্রাণ ঝড়েছে হাটহাজারীর রাস্তায়। দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন রীতা দাশ, দুই ছেলে দীপ ও দিগন্ত, মেয়ে শ্রাবন্তী ও বর্ষা, বড় ননদ চিনু দাশ ও ভাশুরের ছেলে বিপ্লব। একই ঘটনায় সিএনজি চালক বিপ্লব ও রীতার আরেক স্বজন বাপ্পা দাশ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুর্ঘটনা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৪ সালে দেশে প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৩৮০ জনের। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল ২০২১ সালে। সেবার সড়কে মৃত্যু হয়েছিল ৫ হাজার ৮৪ জনের। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে ‘ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি’র (বিআইজিআরএস) করা এক জরিপে দেখা যায় চট্টগ্রাম শহরে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। তিন বছরে ২৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিরাপদে হাঁটার মতো সড়ক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে পথচারীর মৃত্যু হয়েছে ৫৬ শতাংশ। এছাড়া মোটরসাইকেল ও থ্রিহুইলার চালক ও যাত্রীদের মৃত্যু হয়েছে ৩০ শতাংশ। সেই সঙ্গে ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সি গাড়িচালকরা বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন। চিহ্নিত করা হয়েছে দশটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ও সড়ক। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৮১ শতাংশ ছিল পুরুষ। যাদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে। ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সিদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বেশি। এছাড়া ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সি চালকরা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে বিআইজিআরএসের করা ছয়মাস ব্যাপী জরিপে চট্টগ্রাম মহানগরীর ২০২০ থেকে ২২ পর্যন্ত তিন বছরের দুর্ঘটনার চিত্র তুলে আনা হয়।
বেশ কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের স্বপ্নকে কিভাবে ভেঙে দিতে পারে তা দেখেছিলাম মালুমঘাটের সড়ক দুর্ঘটনায়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চকরিয়ায় মালুম ঘাটে একটি পিকআপের ধাক্কায় একই পরিবারের সব ভাই মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তারা চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের সগীরশাহ কাটা গ্রামের মৃত সুরেশ চন্দ্র শীলের ছেলে। দৈনিক কক্সবাজার বার্তায় দেখতে পাচ্ছি মৃত্যু নিশ্চিত করতে গাড়ির ড্রাইভার দুর্ঘটনায় আহত ব্যাক্তিদের দুইবার গাড়ি চাপা দিয়েছে। মানুষ কি নির্মম, কি বর্বর হলে এই ধরনের ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। এই মহাসড়কগুলো যেন মৃত্যুর পুরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বেড়ে চলছে দুর্ঘটনা। গত তিন মাসে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সড়ক দূর্ঘটনায়। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। এভাবে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। আর যেসব লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন অথবা পঙ্গত্ব বরণ করেন তাদের পরিবারের খবর কেউ রাখে না।
এরপরও শৃঙ্খলা নেই সড়ক গুলোতে। ট্রাক থেকে লবণ পানি পড়ে পিচ্ছিল হয়ে মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম – কক্সবাজার আরাকান সড়ক। দিনের বেলায় সামান্য পরিমাণ লবণবাহী ট্রাক চলাচল করলেও সন্ধ্যার পর বেশি সংখ্যক লবণের ট্রাক চলাচল করে এ সড়কে। লবণ পানি আর কুয়াশায় সড়কে লবণ আর ধূলোয় জমাট বাধাঁ আস্তরণ তেলতেলে হয়ে উঠে। এসময় কোন যানবাহন প্রয়োজনের সময় ব্রেক করলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ফিটনেস বিহীন গাড়ি এবং কিছু অদক্ষ ড্রাইভারের জন্য আমরা বাসা থেকে বের হওয়ার পর আবার যে বাসায় আসব তার কোনো গ্যারান্টি নাই। বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমান সময়ে আমাদের চিন্তা চেতনার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। অনেক সময় একটি দুর্ঘটনায় শুধু একজন মানুষের মৃত্যু ঘটেনা। তার সাথে একটি পরিবারের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়।
প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মা বাবা তার প্রিয় সন্তানকে হারাচ্ছেন। সন্তান মা বাবাকে হারাচ্ছেন। অনেক স্ত্রী অকালে স্বামীকে হারাচ্ছেন। বলতে গেলে প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যাথা নিয়ে একটি পরিবারকে সারাজীবন বহন করে চলতে হয়। কিছু কিছু অদক্ষ চালক বেপরোয়া মনোভাব এবং উগ্র মানসিকতার কারণে প্রতিদিন অনেক দুর্ঘটনা আমরা পরিলক্ষিত করছি। অনেক পথচারী প্রতিদিন রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। চাকুরীজনিত কারণে আমি নিজেও প্রতিদিন পাবলিক গাড়ি করে চলাফেরা করি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চিত্র আমার চোখে পড়ে। অনেক বাস এবং ট্রাক চালককে দেখি এত জোরে লক্কড় ঝক্কড় গাড়িগুলো চালান পাশের ছোট গাড়ি দেখারও তাদের সময় থাকেনা। অনেক সময় দেখা যায় গাড়ি চালকের আসনে বাসের হেলপার বসে আছেন এবং তারাই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। এই সব হেলপারের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা সন্দেহ। একই রকম অনেকগুলো সিএনজি অটোরিকশা দেখা যায় যাদের অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও নাই। অনেকের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। আরেকটি বিষয় আমি বেশ পরিলক্ষিত করি যেটা হচ্ছে অনেক মাইক্রো এবং চার চাকার গাড়ি সড়কে চলাচল করছে যেগুলোর মধ্যে অনেক গাড়ি পাওয়া যাবে যেগুলোর গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদ উত্তীর্ণ। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বিহীন গাড়ি চালকের গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যাপারে খেয়াল থাকেনা। জাতীয় উৎপাদনের একটি অংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যয় হচ্ছে। আমি মনে করি যারা সড়ক বিভাগের শৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন তারা আরও কঠোর হলে অনেক দুর্ঘটনার হাত থেকে মানুষ রক্ষা পাবেন। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটিতে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বেশি। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে উঠুক। বাস এবং ট্রাক মালিক সমিতির কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আপনারা দক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ করুন। ড্রাইভারদের বুঝান প্রতিটি জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একজন মানুষের সাথে একটি পরিবারের আশা, ভরসা জড়িত থাকে। আমরা জীব হিসেবে অবশ্যই আমাদের মৃত্যু হবে। তবে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু কারো কাছে কাম্য নয়। বেশিরভাগ ড্রাইভারের লেখাপড়ার মান খুবই কম। এই সব ড্রাইভারদের বাধ্যতামূলক প্রতি ৩ মাসে একদিন সড়ক দুর্ঘটনার কুফল সম্পর্কে বোঝানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে আমার মতে ভালো হয়। প্রত্যাশা করছি সবার জীবন নিরাপদ হবে। এই নিরাপদ জীবনের জন্য আমরা যারা যাত্রী আছি তাদেরকেও সচেতন থাকতে হবে। মেয়াদউত্তীর্ণ গাড়িতে না উঠার অভ্যাস করতে হবে। এই নিরাপদ জীবনের জন্য যা করা দরকার সম্মানিত সরকার তাই করুক। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন থাকব এবং নিরাপদ থাকার চেষ্টা করব। দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা আমাদের দায়িত্ব। মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি যাতে সড়ক পথে না চলে এবং অদক্ষ ড্রাইভার গাড়ি চালাতে না পারে তার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি বাস মালিক সমিতির ভুমিকা রয়েছে।
কর্মরত চালকদের বিপুল সংখ্যক ড্রাগ অ্যাডিকটেড। এছাড়া, অনেকের চোখের সমস্যা রয়েছে।’ দূরপাল্লার যানের চালক ও হেলপারদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই। তাদেরকে অনেক সময় একনাগাড়ে এক থেকে দেড় দিন ডিউটি করতে হয়। আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক টার্মিনালগুলোর পরিবেশের মান চরম খারাপ। এই সড়কটির উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে বিশ্রামগারও তৈরি করে দিতে হবে। তাই আমি এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একজন নিয়মিত যাত্রী হিসেবে অনুরোধ জানাচ্ছি যেন দ্রæততম সময়ে বিভিন্ন মহাসড়কের কাজ শেষ করা হয়। অনেক স্থানীয় অধিবাসী এবং নিয়মিত বাসযাত্রীরা রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দেওয়ার জন্য পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে আসছেন। সব মহাসড়কে ডিভাইডার এবং গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষ সুবিবেচনা করতে পারেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট