অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান মাত্র নন, একজন বিশ্ববরেণ্য বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃত। তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে ‘নতুন বাংলাদেশের’ সঙ্গে ‘নতুনভাবে’ সম্পৃক্ত হওয়ার আহবান জানান। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন প্রাণের সঞ্চার করে বর্ষা ঋতু; এবারের বর্ষায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, তা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে অধিকারের লড়াইয়ে উঠে দাঁড়ানোর সাহস যোগাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের নেতা হিসেবে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে ব্যাপক সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দীর্ঘ অপশাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এ আন্দোলনে আটশর বেশি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে লেখা হয় নতুন ইতিহাস। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়, যা আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণের শুরুর দিকেই বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বস¤প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের, অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে।
ইউনূস বলেন, আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধ প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুলপড়–য়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তীদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে। তপ্ত রোদ, বৃষ্টি, মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে তারা সত্য ও ন্যায়সঙ্গত আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে দীর্ঘকালব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনা করার অশুভ ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করেছিল।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস তার ভাষণে বলেন, উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ রকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও। তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত করা হয়েছিল, রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি’ করে রাখা হয়েছিল, জনগণের অর্থ সম্পদকে ‘নিদারুণভাবে লুটপাট’ করা হয়েছিল, ‘স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’ সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে ‘কুক্ষিগত’ করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এক কথায়, প্রত্যেক পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা ‘অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল’। এরকমই এক অবস্থায় দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।
ইউনূস বলেন, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা তার সরকারের অগ্রাধিকার। মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, আমাদের একজন কৃষক বা শ্রমিকের সন্তানও যেন সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে, সেই লক্ষ্যে বিশালাকার অবকাঠামো নির্মানের বদলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি। রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পক্ষভুক্ত, সেগুলো প্রতিপালনে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক বিশ্বকাঠামোতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অব্যাহত থাকবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের জাতিসংঘের ভাষণ বাস্তবায়নে দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের এগিয়ে আসা জরুরি।