দেশের হাজতখানায় গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি

7

ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের প্রতিটি থানা ও আদালতের হাজতখানাগুলোর পরিবেশ নিয়ে অভিযোগের অনন্ত নেই। তাছাড়া থানা ও পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগগুলো থেকে প্রতিদিন অসংখ্য আসামিদের বিভিন্ন মামলার কারণে হাজিরার জন্য জেলা আদালতে আনা হয়। এসব আসামিদের আদালতের কাঠগড়ায় তোলার আগে তাদের দীর্ঘ সময় হাজতখানায় রাখা হয়। আর এ দীর্ঘ সময়ে হাজতখানায় থাকায় আসামিদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই এদের মনের এ অশান্তি দূর করতে হাজতখানার পরিবেশ উন্নত করা জরুরি। অর্থাৎ হাজতখানা মানে দুর্ভোগ ও ভোগান্তির এমন জায়গা থেকে তাদের জন্য যদি মানবিক হাজতখানা গড়ে তোলা যায়। এর সাথে যদি হাজতখানায় গ্রন্থাগার কর্নার তৈরি করা যায়। সেক্ষেত্রে আসামিদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদের সুবিধার্থে বই পড়ার সুযোগ রাখা উচিত। এছাড়াও এমন কিছু গ্রন্থাগার কর্ণারে সংরক্ষণ করতে হবে যেন সব আসামিদের আকৃষ্ট করে। এতে কিছুটা হলেও তাদের মনের প্রশান্তি দূর হবে। অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য হলো আসামিদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো। এর ফলে সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন গড়া ও ভালো মানুষ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে যুগে যুগে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। তদ্রæপ, আসামিরা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে আদালতের হাজতখানার সুখকর স্মৃতি নিয়েই নিজ পরিবারে ফিরতে পারবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
১৫৫২ সালে লন্ডনে ঝঃ. ইৎরমবঃ’ং ডবষষ নামক প্রসাদে প্রথমে কারাগার নির্মাণ করা হয়। বিশেষত ১৫৯৭ সালে ব্রিটিশ সরকার আসামিদের সংশোধনের জন্য এ ধরনের আরও কয়েকটি কারাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এর ব্যাপকতার কারণে ১৬০০ সালে লন্ডনের প্রত্যেক কাউন্টিতে একটি করে কারাগার নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে ১৮১২ সালে ইংল্যান্তে মিলব্যাস্ক নামে প্রথম জাতীয় কারাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশেষ করে নিজেকে পরিবর্তনের জন্য জ্ঞান-চর্চার বিকল্প কিছু নেই। তাই অপরাধ জগত থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৭৯০ সাল থেকে আমেরিকার সরকার কারাগারে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রেক্ষিতে প্রথম রাষ্ট্রীয় তত্ত¡াবধানে কারাগারের বন্দিদের আত্ম-বিশ্বাস অর্জনের জন্য ১৮০২ সালে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে কারা ব্যবস্থাপনা নতুন আঙ্গিকে বিস্তৃতি লাভ করে। ১৮৩৬ সালে বিভিন্ন জেলায় ও মহকুমা সদরে আসামিদের সংশোধনের জন্যও কারগার নির্মাণ করা হয়। ১৮৭০ সালে প্রগতিশীল সময়কালে কারাগার সংস্কার আন্দোলনের সময়ে জেলা কংগ্রেস প্রতিশোধের পরিবর্তে দোষীদের পুনর্বাসন ও ভালো আচরণের জন্য শিক্ষা এবং পুরস্কারের আহবান জানাতে শুরু করে। তাই আধুনিক সমাজে কারাগারে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা মানে একটি প্রণোদনা হিসেবে দেখানো হতো। কারণ এতে দুস্প্রাপ্য তথ্য সংরক্ষণ করার নির্ধারিত স্থান বলা হয়। যা কারাগারের সংস্কারমূলক লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। উনিশ শতকের শুরুতে কারাগারগুলো সাধারণত যাজকদের দ্বারা পরিচালিত হতো। তদ্রæপ, কারাগার গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ধর্মীয় ভক্তি বৃদ্ধি ও আচরণের পরিবর্তন আনা এবং তাদের নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা। এর প্রেক্ষিতে ১৯১৫ সালে আমেরিকান গ্রন্থাগার অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা কারাগারের গ্রন্থাগারগুলোর জন্য প্রথম ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়েছিল। যা পরবর্তীকালে এর আদলে বাংলাদেশ তথা নারায়ণগঞ্জ, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এর আদালতের হাজতখানায় গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরের সব থানায়, রংপুরের পীরগঞ্জ থানা ও রেলওয়ের কমলাপুরের হাজতখানায় গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে থেকে জানা যায়। এভাবে প্রতিটি থানা ও আদালতের হাজতখানায় গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হলে আসামিদের চরিত্র গঠনে ও জীবন গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ গ্রন্থাগারে কর্নারে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয়ের পড়ার ব্যবস্থা থাকবে। যেমন-অশিক্ষিতদের জন্য পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিটি আদালতের হাজতখানায় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বিশেষ করে সমাজে অনেক সময় শক্রতার কারণে একজন ভালো মানুষকেও অপরাধী বানিয়ে দেয়। এ ধরনের ঘটনা সচরাচর ঘটছে। এর প্রতিকার হওয়া দরকার।
উল্লেখ্য যে, কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে একাকিত্বের কারণে কয়েদিদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে। তাদের চিন্তা-ধারা ও আলাপ-আলোচনা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় জেল ভেঙে পালানোরও চিন্তা করে। এ সব চিন্তা কিন্তু অমুলক নয়। এছাড়াও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে কেউ কেউ অনশনও করে বসে। এ সমস্ত তথ্য অনেক সময় দেশের স্বার্থে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় না। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী বা দার্শনিক রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে শাস্তি হয়ে থাকে। তবে অনেক কবি-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদরা কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে বসে বিখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্য রচনা করেন। এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে দেশে বিদেশে। সে জন্য কারাগারে গ্রন্থাগার কর্নার করা হলে দেশ ও জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে বলে সুশীল সমাজ মনে করে। এক্ষেত্রে আসামিদের মনের জগৎ কিছুটা হলেও পরিবর্তন হতে পারে। এর ফলে আসামিদের মনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাত পারে। এতে হাজতি ও কয়েদিরা কারাগারে বসে বই পড়ে নিজেদের আতœ উপলদ্ধি ঘটাতে পারে। একই সাথে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে একজন ভালো মানুষ হিসেবে কারাগার থেকে বেরিয়ে দেশ ও জাতি গঠনে সহায়তা করতে পারে। সে লক্ষ্যে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো থানার হাজতখানাসহ জেলা কারাগারে গ্রন্থাগার কর্নার স্থাপন করা হলে দেশের ৬৮টি কারাগারের কয়েদিদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে। এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তর তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা কামনা করছে সুশীল সমাজ।
বিশেষ করে কারাগারে বন্দীদের শিক্ষিত, পুনর্বিবেচনা কমাতে এবং পড়ার মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন উন্নত করতে গ্রন্থাগারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এতে বন্দিদের সুষ্ঠুভাবে সমাজে বসবাস করতে সহায়ক হবে। এছাড়া জেলা গ্রন্থাগার অফার করে এমন কিছু প্রোগ্রাম এর মধ্যে রয়েছে-জিইডি নির্দেশনা, স্বাক্ষরতার ক্লাস, জীবন দক্ষতার ক্লাস, টাইপিং নির্দেশনা ও কীভাবে একটি গ্রন্থাগার কর্নার ব্যবহার করতে হয়। এর উপর বিশেষ প্রশিক্ষণসহ বুক মোবাইল আউটরিচ সার্ভিসেস শিক্ষার সুযোগের পাশাপাশি, কারাগারের গ্রন্থাগার কর্নারগুলোর বন্দিদের পরিবারের সাথে ইতিবাচক ও অর্থপূর্ণ যোগাযোগ করতে সহায়তা করবে। যা বন্দিদের সন্তানদের বা নাতি-নাতনিদের সাথে সাক্ষাতের দিনে পড়ার জন্য বই সরবরাহ করবে। অন্যান্য কারাগারের গ্রন্থাগার কর্নারগুলোতে এমন প্রোগ্রাম রয়েছে। যেখানে বন্দিদের গল্প পড়ার রেকর্ড করা হয়। যা কারাগার গ্রন্থাগার কর্নারগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়। এতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও কারাগারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে বন্দিদের মানসিক বিকাশের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
বিষয়টি লক্ষণীয় যে, অনেক বন্দি তাদের বর্তমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে গ্রন্থাগার ব্যবহার করবে। অর্থাৎ কারাগারের গ্রন্থাগার কর্নারের কিছু পরিসেবার মধ্যে একটি হলো কয়েদিদের মধ্যে তাদের পরিস্থিতি নিয়ে কথোপকথনের ব্যবস্থা করা। যা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজে দিবে। অন্যদিকে শিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ায় বন্দিদের অলস ও অস্থির হয়ে পড়ে। এর বিকল্প হিসেবে গ্রন্থাগার কর্নারগুলোতে যদি বাস্তব জীবনের শিক্ষনীয় কিছু বইপত্র সংগ্রহ থাকে। যাতে আসামিরা যেন দিনে কয়েক ঘন্টা গ্রন্থাগার কর্নারে বসে জ্ঞান-চর্চা করতে পারে। সে ব্যবস্থা যদি কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জীবন গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বিশেষ করে গ্রন্থাগার কর্নারটিকে স্বাস্থ্যকর ও বিনোদনমূলক করতে হবে। যা শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও সমর্থন করবে। আমাদের দেশে যদি প্রতিটি কারাগারে একটি করে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার কর্নার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। সেক্ষেত্রে কয়েদিদের আচরণে ও গুণে অনেক পরিবর্তন আসবে। এছাড়া বেশকিছু কারাগারে গ্রন্থাগার রয়েছে। কিন্তু কয়েদিদের জন্য উম্মুক্ত নয়। তাই দেশের প্রতিটি কারাগার ও হাজতখানায় একটি করে গ্রন্থাগার কর্নার গড়ে তোলার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিশেষ করে গ্রন্থাগার কর্নারগুলো আসামিদের জন্য উন্মুক্ত দিতে হবে। বিশেষত সমাজে এদের ভালো মানুষ হয়ে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। এতে দেশ তথা সমাজ অপরাধের দুনিয়া একটু হলেও মুক্তি পাবে। এটাই দেশবাসির প্রত্যাশা।

সূত্র : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম