দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ

3

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।
গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’
দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’নামে পরিচিত হবে।
এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে।
এ ছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’ এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে।
সুপারিশে চার বছর মেয়াদী দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং ২১ বছর বয়সে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পদের শূন্যতায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে গঠিত হবে সেটির সাংবিধানিক রূপরেখাও প্রস্তাব করেছে তারা।
নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, প্রধানমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিভিন্ন রূপরেখা প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সংবিধান সংস্কারের এ কমিশন গঠন করেছে। এ কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আইনসভার নিম্নকক্ষে যে সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে তিনি সরকার গঠন করবেন। নাগরিকতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রয়োগ করা হবে।
কমিশন সুপারিশ করেছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যে কোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন তার জন্য এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে।
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না, এমন সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদ ভেঙে দেওয়ার উপায় হিসেবে বলা হয়, আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি কখনও প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির নিকট এটা স্পষ্ট হয় যে, নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমর্থন অর্জন করতে পারছেন না, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন।

রাষ্ট্রপতির মেয়াদও চার বছর, নতুন নির্বাচন পদ্ধতি : রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদও এখনকার পাঁচ বছরের বদলে চার বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রপতিও সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের পদ্ধতি হিসেবে কমিশন সুপারিশ করেছে, রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে।
কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি’ গঠনের এ সুপারিশ করেছে কমিশন। আইনসভা ভেঙে গেলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন, এমন প্রস্তাব করে সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, আইনসভা না থাকাকালীন এনসিসির রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুইজন সদস্য হবেন এনসিসির সদস্য।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হবার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে বা আইনসভা অকালে ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে সুপারিশে।