সুরেশ কুমার দাশ
দেশের ভবিষ্যৎ যদি হয় বিএনপির হাতে তারা কতটা প্রস্তুত- সেই কথা আসতে পারে। এই যে তরুণ জাতীয়তাবাদী শক্তি বা ছাত্র আন্দোলনকারী তাদের কতটা সামাল দিতে পারবে তারা এই সময়ে। ছাত্র আন্দোলনকারী জাতীয়তাবাদী তরুণ শক্তি তাদের সমান্তরালে তাদের তরুণ রাজনৈতিক শক্তি তাদের মোকাবেলা করতে পারবে কিনা। সেটা আদর্শিকভাবে হোক কিংবা তাত্তি¡কভাবে হোক। যদিও আদর্শ ও তাত্তি¡ক বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ। আর যদি ধরে নিই তাদের আদর্শিক অবস্থান আছে সেই জায়গা থেকে তারা ওই তরুণ শক্তির কাছে পেরে উঠতে পারবে কিনা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মীমাংসা কখনোই হচ্ছে না। সেটার বড় কারণ প্রতিহিংসা। আদর্শিক কারণ বড় নয়। বাংলাদেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু আছে তাতে বার বার জাতীয়তাবাদের ধারণায় বদল আসছে। যেটা মূল সংবিধানকে আঘাত করছে। এটাকে কেউ পাকিস্তানের এজেন্ডা বলে কেউ বলে ভারতীয়। অথচ আমাদের নিজেদের কোনো এজেন্ডা নেই বা সেটা কী বুঝতে আমরা দিন দিন অক্ষম হয়ে উঠছি। এই বিষয়টা তরুণ প্রজন্মের কাছেও অস্পষ্ট। যার কারণে তারাও এই আন্দোলনে নতুন একটা জাতীয়তাবাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাইছে। হিংসা-প্রতিহিংসা থেকে, নানা ধ্যান-ধারণা ও তরুণদের চিন্তা-চেতনা এসব নানা কারণে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে। আর এখন তরুণদের কথা বেশি বেশি করে আলোচনায় আসছে। যারা পুরনোদের ধারণার বশিভূত নয়। ছাত্র আন্দোলনের ফলে আমরা তাদের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চিন্তাচেতনার এই সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করছি। এই পার্থক্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বুঝতে পারেনি এতদিন। এখন বুঝতে পারলে মঙ্গল। এটা সময় বিএনপির, তাই তাদের বোধগম্য হওয়া উচিত দ্রুত। আর বুঝতে না পারার কারণে আওয়ামী লীগের অবস্থার চেয়ে বিএনপির অবস্থান খুব বেশি ভালো নয়। আপাতত যে ভালো আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা বিএনপির বাস্তব অবস্থাও নয়। তারুণ্যকে তারা মোকাবেলা করবে নাকি, তাদের ধারণ করে নিজেদের এগিয়ে নিতে তাদের আদর্শিক বা জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করবে সেটা তাদের ভাবতে হবে। কিন্তু এই তারুণ্য কী? সেটাও তাদের দেখতে হবে। শুধু ক্ষমতার জন্য চিন্তা করলে এদেশ ভবিষ্যতের জন্য কারো হবে না। সেই টাকা পাচার থাকবে। নানাভাবে বেগমপাড়া, বিবিপাড়া ও সাহেবপাড়া সৃষ্টি হবে। যারা এখানে থাকবে তারা শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হবে।
তারুণ্যের শক্তি যেটাকে দেখা গেছে, তাদের সাথে বিএনপির শক্তি পার্থক্য আছে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনৈতিক শূন্যতার একটি বিষয় আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, তারা সেভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তারপরও এটা কোনো অজুহাত হতে পারেনা রাজনৈতিক দল হিসাবে। যোগাযোগও তাদের সেই অর্থে ছিল না। আওয়ামী লীগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দাপিয়ে বেড়ালেও তারা তারুণ্যের শক্তি বা আকাক্সক্ষাটা বুৃঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। বলতে গেলে পেশিশক্তি ব্যবহার করেছে, প্রতিপক্ষ ভেবে চড়াও হয়েছে, হানা দিয়েছে। এজন্য পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে প্রতিশোধস্পৃহা। এসব কারণে শুধু ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে নয়, দূরত্ব বেড়েছে সাধারণ ছাত্রদের সাথেও। এই অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি জারি থাকলে সকলে তরুণ শিক্ষিতদের ধারণ করতে পারত। তাদের সাথে অবাধ সম্পর্ক না থাকার কারণে তাদের ভাবনা রাজনৈতিব দলগুলোর মধ্যে ধারণ করার মনমানসিকতা সৃষ্টি হয়নি। যে কারণে নবশক্তির তরুণরা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের নতুন ধারণা তারা নিজেদের মধ্যে লালন করেছে। আন্দোলনে অন্তত তার কিছু প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি। আমাদের ধারণা ছিল – আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য খুচরো বাম সংগঠনগুলো ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। কিন্তু সেই ধারণা কতটা ভুল তার প্রমাণ মিলেছে ইতিমধ্যে। বাংলাদেশের রাজনীতির আরও একটা সঙ্কট- এদেশের প্রতিটি মানুষের আলাদা রাজনৈতিক ধ্যানধারণা আছে। এই ধ্যানধারণাকে দলগুলো সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা হিসাবে মেলাতে পারিনি। এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা বা ঐক্যবদ্ধ করা। ছাত্র আন্দোলনকারীদের দেয়াল লিখন ও বিভিন্ন মাধ্যমে আসা তাদের বক্তব্যগুলো লক্ষ করলে আমরা তাদের ধ্যানধারণাগুলো অন্তত কিছুটা বুঝতে পারি। তারা বৈষম্যমুক্ত সমাজ চায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ নির্বিবেশে বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার। কথা বলার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। ধনি-গরিবের বৈষম্য বিলোপ। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।
এদেশে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার গরিবের সমর্থন। যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হুজুগে, অধিকার সচেতন নয়। কিন্তু তেমন একটি ঘরের সন্তান আবু সাঈদ অধিকারের দাবিতে পুলিশের সামনে বুক খুলে দিয়ে পুলিশের গুলি বুকে ধারণ করে আত্মবলিদান করেছে। দেখতে হবে- আবু সাঈদের পিতা সাধারণ একজন গরিব বাঙালি পরিবারের প্রতিনিধি। তার নিজের কোনো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা না থাকলেও তার শিক্ষিত সন্তানের মধ্যে রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভবিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তার পিতা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে এসেছে তাদের পরবর্তি প্রজন্ম এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করছে। সুতরাং গরিব বলে তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা বা তাদের অধিকারকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তাদের রাজনৈতিক মতামত ছিল, যা অতীতে বুঝতে চায়নি দলগুলো। কারণ তখন রাজনীতি সহজ ছিল। এখন তাদের সন্তানরা শিক্ষিত, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের বঞ্চনার ক্ষোভ ধারণ করতে পারে। একই সাথে শিক্ষা ও অশিক্ষার পার্থক্য বুঝতে হবে। শিক্ষিত সমাজে কিভাবে রাজনীতি করব আর অশিক্ষত সমাজে কিভাবে রাজনীতি করব।
এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শুধু শেখ হাসিনার মত ছাত্রলীগের চোখ দিয়ে দেখলে চলবে না। যাদের রাজনীতির কারণে সাধারণ তরুণ মেধাবী ছাত্ররা প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। যেখানে রাষ্ট্রের মূল চেতনার বিষয়গুলোও প্রতিপক্ষের ক্ষোভে ভস্মীভূত হয়েছে। তাদের কেউ আবার এই ক্ষয়ক্ষতির বেদনা অনুভব করে না। এই সহানুভূতি সম্পন্ন প্রজন্ম আমরা তৈরি হতে দেইনি। এভাবে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ধারণার পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে বার বার। আধুনিক বিশ্বে গতানুগতিক রাজনৈতিক প্লাটফরম থেকে বের হয়ে শিক্ষিতরাই রাজনীতি পরিচালনা করছে, যারা সব নাগরিক আকাক্সক্ষা ও অধিকারকে সমন্বয় করার শক্তি বুঝতে সক্ষম।
গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্ল্যাটফরমের বাইরে তরুণদের মধ্যে যে রাজনৈতিক অধিকারবোধ সৃষ্টি হচ্ছে সেটা, এটা অযৌক্তিক কিছু নয়, বরং আমাদের মধ্যে এক পক্ষকে বঞ্চিত করে আসার যে কৌশল সেই রাজনৈতিক কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই কৌশলের মধ্যে আছে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট। আরব্য রজনীর হাজার রাতের গল্পের মত আর টাকা পাচার আর খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংক লুটের গল্প। এসব ঘটনাগুলো তরুণরা কিভাবে নিচ্ছে, আর আমরা ভাবছি কেউ দেখছে না বা জানছে না। বিষয়টা সেরকম নয়। তাই বৈষম্য ও বঞ্চনার যে চিত্র সেটা যদি রাজনৈতিক কৌশল না হয়েও থাকে তাদের মধ্যে কী ধরনের আকাক্সক্ষা তৈরি হচ্ছে সেটা বোঝার ক্ষমতা রাজনীতিদিদের থাকতে হবে। তাই গতানুগতিক রাজনৈতিক প্লাটফরম ব্যবহার করে রাজনৈতিক চাল দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে এই যে গণবিষ্ফোরণ সেটা থামানো যাবে না। অন্তত এই আন্দোলনের উত্তাপ এদেশে অনেকদিন থাকবে। সেই আঁচ থাকবে, রেশ থাকবে। এটা আঁচ করার শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর থাকতে হবে।
এই আন্দোলনের কারণে এদেশের সাথে একটা বৈশ্বিক যোগসূত্রও নতুনভাবে তৈরি হয়েছে। আমাদের চরিত্রচিত্রন পাঠ করেছে বিদেশিরা। এছাড়া এ ধরনের আন্দোলনের সন্ধিক্ষণের মৌলবাদের আস্ফালন বাড়ে। এই যোগসূত্রকে কাজে লাগিয়ে মৌলবাদকে আড়াল করার একটা পরোক্ষ উপায় থাকলেও বৈশ্বিকযোগ মৌলবাদী শক্তিকে ইন্ধন যোগাতে পারে পুরোদমে। আজকের আফগানিস্তান এমন কিছু পরিস্থিতি থেকে আজ তালেবানি শাসন কায়েম হয়েছে। যখন তাদের জনগণ বলতে বাধ্য হচ্ছে- এটাই তাদের প্রকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা। কারণ নিরুপায় হলে সেটাই ভাগ্যের লিখন হয়ে যাবে। যদি এমন দুর্দিন আসে বাংলাদেশের মানুষও এমনতরো বলতে বাধ্য হবে। হয়ত এতে একটু সময় লাগতে পারে মাত্র।
পৃথিবীতে যারা চরম স্বৈরাচারি রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে সেখানকার রাষ্ট্রগুলো ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে আর্থিক চাহিদার পরিবৃত্তে সামাল দেওয়া হচ্ছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষোভের কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে, আমাদের মত দেশে যেটাকে প্রতিহিংসা বলে চালানো যায়। গণতান্ত্রিক সাম্যতার হিসাবে ‘তোমার থাকলে আমারও থাকতে হবে’। ধনি হও, গরিব হও তা চলবে না। সেটার একটা চেক এন্ড ব্যালেন্স দরকার। তাই নাগরিক আকাক্সক্ষার কোনো শেষ নেই। যে কারণে রাষ্ট্রকে পরিমিত আচরণ করা শিখতে হবে। কিন্তু কিছু মানুষ যদি বাংলাদেশের ব্যাংক লুট করে লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচার করে নিশ্চিন্তে থাকে, দিনের পর দিন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, চাঁদাবাজী, তোলাবাজী, দ্রব্যমূল্যের স্টিমরোলারে পিষে দিয়ে নিরব-নিশ্চুপ থাকে রাষ্ট্র তথা সরকার নিশ্চিন্ত বোধ করে তাহলে, তার পরিণতি দেখা গেছে। যে কারণে তারুণ্যের চিন্তাচেতনাকে আত্মস্থ করে, তাদের ধারণ করে, সংগঠিত করে দেশ পরিচালনার লক্ষ্য থাকা উচিত- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য।
লেখক: সাংবাদিক