দেশের বিমা খাতের বর্তমান পরিস্থিতি

1

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের সুষম ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অর্জনের জন্য বিমা খাতের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের এ খাতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বিমা খাতের তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। অর্থাৎ বিমা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো স্বতস্ত্র কোনো সংস্থা ছিল না দীর্ঘদিন। তবে বিগত বছরগুলোতে অনেকেই বিমাকে ট্রেডিং ব্যবসা বলে মনে করতেন। আসলে এটি কিন্তু ট্রেডিং ব্যবসা নয় বরং এটি একটি জনসেবামূলক ব্যবসা। এর কারণ এখানে জনগণের কাছ থেকে নেয়া অর্থ নির্দিষ্ট সময় পর লাভসহ ফেরত দেয়ার বিষয়টি জড়িত। অথচ বীমা খাতে পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমম্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি বলেই বিমা খাতে প্রত্যাশিত মাত্রায় উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। এর প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে আইডিআরএ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে সুশাসন প্রবিধানমালা চুড়ান্ত করা হয়েছে। গত দু’বছর ধরে বিমা খাতে কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করছে। এর সাথে সাথে কর্পোরেট গর্ভন্যান্স নীতিমালাসহ ‘গ্রাহক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও তথ্য যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়া অত্যাধুনিক করা হয়েছে।
বিশেষ করে ২০১০ সালের বিমা আইন প্রণয়নের পূর্বে ব্রিটিশ আইনের অধীনেই বাংলাদেশের বিমা খাত পরিচালিত হয়। অর্থাৎ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠনের পর কোম্পানিগুলোতে জবাবদিহিতাসহ শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করছে। যদিও এ খাতটি স্বাধীনতার পর ব্যাংকিং খাতের সাথে সমান্তরালভাবে চালু করা হয়েছিল। অথচ ১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন করেও ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা সম্ভব হয়নি। এর পাশাপাশি বেশ কিছু কোম্পানিতে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও তহবিল আতœসাতের কারণে দেশে তারল্য-সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। তবে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ মানুষ বিমার গ্রাহক। আর মালয়েশিয়া ও ভারতে বিমার গ্রাহক যথাক্রমে ৫ ও ৪ শতাংশ বিদ্যমান। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে মাত্র ৫৭টি আর মালয়েশিয়ায় মাত্র ২৫টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। অর্থাৎ ভারতের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও সেখানে কিন্তু বীমা কোম্পানির সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কম। আর বাংলাদেশে ৮১টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কিছু কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ এতগুলো বিমা কোম্পানি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই যৌক্তিকতা ছিল না। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা আওতায় আনা হয়। এক্ষেত্রে নিকটবর্তী দেশ ভারতেও প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বিমা আওতায় আনা হয়েছে। অথচ সে অনুপাতে মানুষ স্বাস্থ্য বিমা আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে দেশে প্রায় ৮৬ লাখ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। অর্থাৎ দেশে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত খরচের জন্য হতদরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বিমা কোম্পানি হওয়ার কারণে সীমিত সংখ্যক গ্রাহক নিয়ে কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনৈতিক ও অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা চলছে। এতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বদিচ্ছা ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি আর্থিক কেলেস্কারি বিমা খাতকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এসব আর্থিক কেলেংকারি বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিমা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, আর্থিক ও তহবিল আতœসাতের যেন মহোৎসবের মতো ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সময়ে সুযোগ সন্ধানী কিছু গোষ্ঠী দেশের বড় বড় বিভিন্ন স্থাপনাগুলোতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ জানমালের বিপুল ক্ষতিসাধন করছে। বিষয়টি লক্ষণীয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো কিন্তু বিমার আওতায় থাকে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের এত বড় বড় মেগা প্রকল্পের কিন্তু কোনো বিমা আওতায় আনা হয়নি। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘বাংলাদেশের বিমা খাত উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে জন্য তহবিল গঠন উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায় যে, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা কর্পোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কিন্তু শক্তিশালী করা সম্ভব হয়নি। সে সাথে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স কভারেজ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য যে, গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের গড় আয় ও প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ‘দেশের বিমা খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও কৌশল’ শীর্ষক একটি গবেষণার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়টি ওঠে এলেও এর পেছনের কারণগুলো সেভাবে উঠে আসেনি। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর একাংশ দাবি পরিশোধ না করার জন্য বিমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ। এর ফলে দেশের মানুষের মধ্যে জীবনবিমা গ্রহণের হার বাড়ছে না বরং কমছে। অন্যদিকে দেশের বাহিরে উন্নত দেশগুলোতে ভ্রমণ কিংবা চাকরি সুবাধে গেলে সেখানে অবশ্যই বিমা পলিসির আওতায় আসতে হয়। অথচ আমাদের দেশে এখনো বিমা খাতকে বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বিমা খাতকে সর্বস্তরের জনজীবনের সাথে যুক্ত করতে হলে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতের প্রতি জনগণের প্রথমেই আস্থার অভাব দূর করতে হবে। আর সময়মতো গ্রাহকদের দাবি নিম্পত্তি ও বৈচিত্র্যময় পণ্য এবং পরিসেবা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ভারতে গড় দাবি নিম্পত্তির অনুপাত ৯৮ শতাংশ। এমন চিত্র বাংলাদেশে হওয়া উচিত বলে সুশীল সমাজ মনে করে। অন্যদিকে তহবিলের বিচক্ষণ ব্যবহারের মাধ্যমে তারল্যের সীমাবদ্ধতা কমিয়ে আনতে হবে। এর সাথে এ খাতের উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকারকেও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। এতে করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা কর্পোরেশনগুলোকে শক্তিশালী ও আধুনিকায়ন করতে হবে। এর ফলে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমা খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ বিষয়ে আরও জানা যায়, চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক খাতের লেনদেন সহজীকরণ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের উপর গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। এ আর্থিক খাতের ঝুঁকি নিরসনের ক্ষেত্রে বিমা খাত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে বিমা খাতের পরিসর সীমিত। তাই বিমা খাতকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নতি করার জন্য ইতিমধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কার শুরু করছে। এ লক্ষ্যে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থাৎ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদারকি ও নজরদারি আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষ করে দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো বিমার আওতায় আনা জরুরি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা বিমা খাতকে ধ্বংস করছে। তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রæত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে জনগণের আস্থা ফিরে আসতে পারে। এছাড়া বিমা খাতের তত্ত¡াবধানে সক্ষমতা অর্জন ও সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য অধিকতর উপযোগী নীতি ও পদ্ধতি প্রবর্তন করাও জরুরি। একই সঙ্গে বিমা খাতের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, প্রশিক্ষিত জনবল উন্নয়ন ও পেশা দায়িত্ব বৃদ্ধি করা। সে সাথে এ খাতে মানুষের আস্থা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।

লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম