মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
আলহাজ্ব মোহাম্মদ মহসিন। যিনি ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সকাল পর্যন্ত দেশের খ্যাতনামা দ্বীনি সংস্থা আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ‘র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহুল পরিচিত ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭৯-১৯৮৩ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে, এবং ১৯৮৩ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২৫ পর্যন্ত ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করে গেছেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী (র)ও ১৯৭৯ পর্যন্ত আনজুমানের উক্ত সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী ছিলেন আল্লামা গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্(র) মনোনীত ‘খলিফায়ে আযম’, এবং শাহানশাহে সিরিকোট, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (র)’র বিশিষ্ট মুরীদদের অন্যতম। যতটুকু জানা যায়, নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতা। চট্টগ্রাম সংবাদ পত্র শিল্পের পথিকৃৎ আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মাধ্যমে, তাঁরই আন্দরকিল্লা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের দ্বিতীয় তলায় পন্ঞ্চাশের দশকে তিনি হযরত সিরিকোটি হুজুরের মুরীদ হয়ে যান, এবং চট্টগ্রাম ষোলশহরস্থ এশিয়ার অন্যতম সেরা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা এবং আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠায় শীর্ষস্থানীয় সহায়তাকারী হিসেবে অবদান রাখেন। আজকে বাংলাদেশের বহুল জনপ্রিয় জসনে জুলুস ১৯৭৪ সনে তাঁর নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম কোরবানি গঞ্জ বলুয়ারদীঘি পাড় খানকাহ্ শরীফ থেকে বের হয়েছিল, যার রুপকার ছিলেন গাউসে জামান আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ (র)। বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকাহ্ শরীফটি ১৯৬৫ সনের দিকে তিনি নিজ বাসভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা জুড়ে চালু করেন, যা অদ্যাবধি সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়া প্রচার প্রসার ও চর্চার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল কাদেরীর মেঝ ছেলে ছিলেন মোহাম্মদ মহসিন সাহেব। ১৯৭৯ সনে পিতা নূর মোহাম্মদ আল কাদেরীর ইন্তেকালের পর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইন্তেকাল পর্যন্ত ৪৫ টা বছর তিনি আনজুমান -জামেয়ার খেদমতে ছিলেন বরাবরই নিরলস,নিরবিচ্ছিন্ন, আপোষহীন এবং দৃঢ়তার প্রতীক। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ তাঁকে খুব স্নেহ করেই এনেছিলেন, এবং একদম অল্প বয়সেই এতোগুলো সিনিয়র পীর ভাইদের রেখে উনাকে তুলে দিয়েছিলেন এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ জিম্মাদারি। একজন দুরন্ত চঞ্চল তরুণ ভবিষ্যতে কী আর অবদান রাখতে পারবে, পারবে না এই নিয়ে কতো ছিল জল্পনা কল্পনা, মন্তব্য, সন্দেহ একের পর এক প্রকাশ পাচ্ছিল। তাঁদের জন্য হুজুর কেবলা (রা)’ একটি মন্তব্য ছিল চিরসত্য এবং প্রনিধান যোগ্য। আর, তা হলো, ‘বা’জি আগর চাহে ত সুকনি লাকড়ি সে ভি কা’ম লে সেকতা’। যারা কমবয়সী হবার কারণে মহসিন সাহেবকে অমর্যাদা করবার, গুরুত্বহীন ভাববার বা
অসম্মান করবার সম্ভাবনা ছিল তাদের জন্য দায়িত্ব দাতা হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ হুজুর বলেছিলেন —‘মহসিন মেরে জা’গা পর’। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আমৃত্যু এই মহসিন সাহেব এই অঙ্গনে এতোটা অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠেছিলেন যে,তাঁকে ছাড়া এই ঘরানার কিছুই কল্পনা করা যায় নি। দরবারে সিরিকোটের মাশায়েখ হযরাতে কেরামের কাছে মহসিন সাহেব ছিলেন একক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাঁর কাছেও দরবারের হযরাতে কেরামের কোন সাযুজ্য, বিকল্প ছিল অকল্পনীয়। পীর, দরবার,জামেয়া, আনজুমান, গাউসিয়া কমিটি বিষয়ে তিনি এতোটা আপোষহীন ছিলেন যে, সবার কাছে তাঁর কট্টর অবস্থান সহজেই ধরা পড়ত। সিরিকোটি হুজুর ইন্তেকালের অব্যবহিত পূর্বে আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম কে বলেছিলেন, আবু মিয়া! জিসম মেরা সিরিকোট মে হ্যা, মগর রুহ মেরা বাঙ্গাল মে পড়া হুয়া হ্যা’। ঠিক তেমনি, এই কথা সবাই জানে যে, মহসিন সাহেবের মনটা বরাবরই পড়ে ছিল দরবারে সিরিকোটের অলী গলিতে। কখনো কখনো এমন কোন মাস ছিল না যে তিনি দরবারে না গিয়ে দেশে বসে ছিলেন। গুরুতর অসুস্থতাকেও কোন পরোয়া না করে তিনি ছুটে গেছেন হুজুর কেবলা র কাছে, সিরিকোট শরীফের পথে। হুজুর কেবলারাও যতদিন বাংলাদেশ সফরে থাকতেন ততদিন মহসিন সাহেব একটা মুহূর্তের জন্যই নিজ ঘরে যেতেন না। থেকে যেতেন হুজুরের খেদমতে, খানকাহ্ শরীফে বা হুজুরের অবস্থানস্থলে।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬, ফজরের নামাজ আদায় করলেন বাংলাদেশ সফররত পীর সাবির শাহ্ হুজুর এবং শাহজাদা আল্লামা কাসেম শাহ্ র সাথে চট্টগ্রাম আলমগীর খানকাহ শরীফে। নামাজের পর তাঁর একটু শরীর খারাপ লাগছে শুনতেই উভয় হুজুর কেবলা নিজেদের কক্ষ ছেড়ে চলে এলেন মহসিন সাহেবের কক্ষে। তাঁরা নিজেরাই শুরু করেন প্রাথমিক চেক আপ। নিজেদের সাথে থাকা মেশিনে মাপলেন প্রেসার আর ডায়াবেটিস। বুকে, মাথায় তাঁদের নূরানী হাত বোলালেন। বললেন, ভালো করে ঘুমিয়ে যেতে। হুজুর কেবলা বের হবার পর মহসিন সাহেব একটু পানিও পান করে নেন। আবারও একটু খারাপ লাগছে।দ্রæত আবারও চলে আসলেন পীর সাবির শাহ্ হুজুর এবং শাহজাদা সাহেব। তাঁদের আসা’টাতে মহসিন ভাই বারবার লজ্জিত হচ্ছিলেন।কষ্ট পাচ্ছিলেন এমন নূরানী শাহী মেহমানদের বিচলিত অবস্থা দেখে। তিনি কয়েকবার উঠে দাঁড়াতে চান। বলেন,হুজুর! আমি ভালো আছি। আপনারা বিশ্রাম নেন, রুমে চলে যান। যাক্, এ অবস্থাতেই তিনি চির ঘুমের দিকে এগুতে থাকেন। হুজুর কেবলা হাসপাতালে নিতে বললেন। উনারা উভয়ই মহসিন ভাই কে আল্লাহর হাওলা করলেন। নিজেরা খানকাহ শরীফের তৃতীয় তলা থেকে নিচে নেমে তাঁদের প্রিয় মহসিন ভাই কে গাড়িতে তুলে দেন, নিঃশব্দে চোখের পানি মুছতে মুছতে। হাসপাতালে নেওয়াটা ছিল শান্তনা মাত্র। হ্যাঁ, হাসপাতাল থেকে সেই খবরটিই এলো—তিনি ত নাই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি চলে গেলেন তাঁর প্রিয়তমের কাছে চিরতরে।তাঁর কবর ঠিক করলেন হুজুর কেবলারা। তাঁর বাবাজি আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী (র)’র মাজার অভ্যন্তরে, তাঁর পাশেই শায়িত করা সাব্যস্ত হয়। দুই হুজুর কেবলা নিজেরা কোদাল হাতে তুলে নেন, এবং তাঁর কবর খনন কাজ শুরু করেন। জানাজায় ইমামতি করেন পীর সাবির শাহ্ হুজুর। লাখো মুসল্লীর উপস্থিতি ছিল জামেয়ার জুলুস ময়দানের জানাজায়। দোয়া তে সশব্দে কাঁদলেন হুজুর কেবলা, কেঁদে ওঠে এবং কেঁপে ওঠে সমগ্র ময়দান। খাটিয়া কাঁধে নিতেও হুজুর কেবলা দের দেখা গেছে স্বহস্ত সহায়তা দিতে। দাফন কাজেও থাকেন ওনারা। কবরে মাটিও দেন নূরানী হাতে।
হুজুর কেবলাদের সফর শেষ করে দেশে ফেরার কথা ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর। মহসিন সাহেবের অনুরোধে যাবার তারিখ হয় ২৬ সেপ্টেম্বর। কী রহস্য! ২৫ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন তাঁদের প্রিয় মহসিন ভাই। চলে যান তাঁদের হাতেই। পরদিনও আর যেতে পারলেন না। মহসিন সাহেবের ইন্তেকালের চতুর্থ দিবস চাহরম করে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।সত্যিই এমন জীবন, এমন মরণ সত্যিই বিরল, অসাধারণ।
কতটুকু ভালবাসা এই মহসিন আর দরবারে সিরিকোটের মধ্যে, তার বড় প্রমাণ হলো, দাফনের আগেই তাঁর একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ গোলাম মহিউদ্দিন কে বানানো হলো আনজুমান ট্রাস্টের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এটা কারো প্রস্তাবে নয়, সরাসরি হুজুর কেবলাদের মনোনয়নে সম্ভব হয়েছে। হুজুর কেবলা, গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মাদ তাহের শাহ্, মহসিন সাহেবের ইন্তেকালের প্রেক্ষিতে লেখা চিঠিতে বলেছেন,জামেয়া-আনজুমান সিলসিলাহর জন্য মহসিন সাহেবের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল, এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সবাই কে দ্বীনি খেদমত করার তৌফিক চেয়ে আল্লাহর দরবারে তিনি ফরিয়াদ জানান।
লেখক : বিশিষ্ট আইনজীবী, লেখক ও গবেষক