দেয়ালের ওপারের কঠিন বাস্তবতা

0

মো.শাহরিয়ার হোসেন শিমুল

সম্প্রতি একটি দাপ্তরিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কারাগারের উঁচু দেয়াল এবং লোহার ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। কারাগারের পরিবেশ যেমন নিস্তব্ধ, তেমনই তা গভীরভাবে চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়।
ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই চোখ পড়ল ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের একটি তালিকার ওপর। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই তালিকায় দেখা গেল একসময়ের ক্ষমতাধর ব্যক্তি সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং পরিচিত রাজনীতিকদের নাম। কিছুদিন আগেও যাঁরা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, যাঁদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান মুখরিত থাকত, যাঁদের একটি সিদ্ধান্তে মানুষের ভাগ্য বদলে যেতো, আজ তাঁরাই বন্দি। দেয়ালের কঠোর পরিসরে, আইন ও নিয়মের শৃঙ্খলে তাঁরা আবদ্ধ। ক্ষমতার মসনদ থেকে কারাগারে আসা এই ব্যক্তিদের পরিণতি দেখে মনে হলো, সময়ের চাকা কতটা নির্মমভাবে মানুষকে ঘুরিয়ে দেয়।
কারাগারের বাইরের চিত্রটিও কম হৃদয়বিদারক ছিল না। ফটকের বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও পিতা একসময় ছিলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আজ তাঁরা দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন কেবল একটিবার প্রিয়জনের দেখা পাওয়ার জন্য। তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, ক্লান্তি আর একরাশ বেদনার ছাপ স্পষ্ট। এই দৃশ্য দেখে যে কারো মন ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য।
আমার সঙ্গে থাকা এক সহকর্মী খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন, ‘হাসপাতাল আর কারাগার এই দুই জায়গায় এসে মানুষ উপলব্ধি করে, আমরা কতটা ক্ষণস্থায়ী, কতটা অসহায়।’ এই কথার প্রতিটি অক্ষর যেন বাস্তবতাকে মূর্ত করে তুলেছিল। ক্ষমতা, অর্থ, পদ কিংবা প্রভাব এগুলো সময়ের সঙ্গে একে একে ঝরে পড়ে। কিন্তু মানুষ এই কঠিন সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর পঙক্তি এই প্রসঙ্গে বড় প্রাসঙ্গিক মনে হলো:
‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়,
আজকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়।’
আমরা যারা এখনো বাইরের দুনিয়ায়, দাপ্তরিক ব্যস্ততায় মগ্ন কিংবা ক্ষমতার বলয়ে বিচরণ করছি, আমাদের সবার জন্য এটি এক বড় শিক্ষা। অহংকার, ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা সীমাহীন লোভের পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা এসব কারাগারের দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
আজ যারা ক্ষমতাবান, প্রতিপত্তিশালী, তাঁদের উচিত এই বাস্তবতাকে সর্বদা স্মরণে রাখা। পদমর্যাদা ক্ষণস্থায়ী, তা আসবে আর যাবে; কিন্তু মানবিকতা, নীতিবোধ এবং আত্মজিজ্ঞাসাই মানুষকে সত্যিকার অর্থে মহান করে তোলে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে নীতিবিবর্জিত পথে চললে তার পরিণতি কী হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই কারাগারের ভেতরেই বিদ্যমান।
কারাগারের ফটক থেকে বেরিয়ে আসার সময় এক গভীর উপলব্ধি নিয়ে ফিরছিলাম। মনে হচ্ছিল এখানে আসা প্রতিটি মানুষের উচিত নিজেকে একবার আয়নায় দেখা। সময় বড়ই নির্মম, সুযোগ সবাইকে সমান না দিলেও, হিসাব একসময় ঠিকই বুঝে নেয়। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু একটি ভুল সিদ্ধান্ত চিরস্থায়ী অনুশোচনা বয়ে আনতে পারে। এই মৌলিক সত্যটি যদি আমরা ভুলে না যাই, তবে হয়তো অনেক অনিবার্য পতন ঠেকানো সম্ভব হবে। ভবিষ্যতের পথচলায় এই শিক্ষা আমাদের পাথেয় হোক।

লেখক : নেটওয়ার্ক অফিসার, বারাকা ( একটি কারিতাস কেন্দ্রীয় প্রকল্প)