দূষণের কবল থেকে মুক্তি মিলছে না হালদার

116

ঈদুল ফিতরের কারণে পিছিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে জাতিসংঘ। এ বছর পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আসুন, বায়ু দূষণ রোধ করি’। এভাবে প্রতিবছর এ দিবটিকে উপলক্ষ করে লেখালেখি, মিছিল-মিটিং, সভা-সেমিনার আরও কত কিছুই না হয়। উদ্দেশ্য প্রকৃতির ভারসাম্য তথা পরিবেশ দূষণমুক্ত করা।
অথচ পরিবেশের দূষণ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশের একমাত্র মিঠা পানির কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র রুপালি সম্পদের খনি খ্যাত ঐতিহ্যবাহী হালদা নদী। মাছের অভয়ারণ্য হালদা নদী তার চিরচেনা রূপ প্রতিনিয়তই হারাচ্ছে। কার্প জাতীয় মা-মাছের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে প্রতিদিন কারখানার বর্জ্য, পয়োবর্জ্য ও পোলট্রি ফার্মের বর্জ্য নিক্ষেপ, নদীর তীরবর্তী চাষাবাদের জমিতে কীটনাশক ব্যবহারসহ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে হালদা। ফলে হালদা নদীর ৭২ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৫ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যা অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। জানা যায়, হালদা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্প-কারখানা। বন্দর নগরী ও উত্তর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উপজেলার অধিবাসীদের পয়োবর্জ্য এবং বিভিন্ন পোলট্রি ফার্মসহ নানা মিল-কারখানার তরল বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি এসে পড়ছে হালদায়। তীরে চাষাবাদ করা জমিগুলোতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা এসে সরাসরি পড়ছে হালদায়। অন্যান্য কলকারখানার দূষণ তো রয়েছেই। এসব কারণে হালদা রুই মা-মাছের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। দূষণের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি মিলছে না হালদা নদীর। তবে বিশেষায়িত এ নদী সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ থাকলেও দৃশ্যমান কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ চোখে পড়েনি হালদা পাড়ের মানুষের।
বন্ধ হচ্ছে না রাসায়নিকসহ বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য নিক্ষেপ, রোধ করা যাচ্ছে না দূষণ। হালদার হাটহাজারী অংশের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি মুরগির খামারের বর্জ্য পড়ছে নদীতে। ফেলা হচ্ছে হাট বাজারের জবাই করা পশু-পাখির নাড়ি-ভূড়ি। আর বিভিন্ন খালের মাধ্যমে নদীতে এসে পড়ছে রাসায়নিক তরল বর্জ্য। হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর ও শিকারপুর ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে চলা কৃষ্ণখালী খালটি উক্ত এলাকার বিভিন্ন গ্রাম হয়ে নজুমিয়াহাটের পাশ দিয়ে যুক্ত হয়েছে উত্তর প্রান্তের খন্দকিয়া খালের সাথে। কৃষ্ণখালীর সকল বর্জ্য খন্দকিয়া খাল হয়ে পড়ছে হালদা নদীতে। কৃষ্ণখালের বিষাক্ত কালো পানির পচা বর্জ্য গোটা এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের কারণে মশা-মাছির বংশ বিস্তার ঘটছে। এছাড়া রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের সাকদা এলাকায় একটি ইটভাটার কবলে গেছে নদীর বিশাল অংশের মাটি।
তাছাড়া ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পুরাতন ব্রিজ থেকে নারায়ণহাট পুরাতন ব্রিজ পর্যন্ত হালদা নদীর বিভিন্ন স্থানে বর্জ্যরে ভাগাড়। নাজিরহাট বাজারের পশ্চিম পাশে হালদা পাড়ে গরু-ছাগল জবাইয়ের পর সেই বর্জ্যসহ বাজারের সব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে হালদায়। বাজারের পশ্চিম পাশে মাছ বাজারের ময়লা, কাঁচাবাজারের ময়লার নিরাপদ স্থান হচ্ছে হালদার পাড়। এসব আবর্জনা পচে জোয়ারের সময় হালদার পানির সঙ্গে মিশে নদীর স্বচ্ছ পানিকে করছে বিষাক্ত।
ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে নদী তীরবর্তী মানুষ ও মৎস্যজীবীরা বলেন, বিভিন্ন সময় কথার ফুলঝুরি নিয়ে আসা সরকারি কর্মকর্তারা হালদা নদীতে স্পিডবোট নিয়ে দায় সাড়া নৌ-ভ্রমণই করে গেছেন। যাওয়ার সময় নদীকে দূষণমুক্ত করতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের কথা শুনিয়ে শুধু আশ্বস্থই করে গেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হালদা রক্ষায় বহুমুখি প্রকল্প গ্রহণের কথা শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত নদী নজরদারীর জন্য কোনো নৌযান বা জনবল আসার খবর আমাদের কাছে নেই।
এদিকে পরিবেশবিদরা মনে করেন, শিল্প-কারখানা, কৃষি ও পয়োবর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় হালদায় ফেলার ফলে দিন দিন মাছের বসবাসের প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপÍ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হালদা মাছশূন্য হয়ে পড়বে। অখচ বিশেষায়িত এ নদী ও মৎস্য সম্পদকে রক্ষায় প্রায় একদশক ধরে নদী পাড়ের মানুষ পরিবেশবাদী ও হালদা রক্ষা কমিটির সঙ্গে আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ হলে তিনি এই নদীকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নির্দেশনাও প্রদান করেন। কিন্তু তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ মানুষ দেখছেন না।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, দূষণের কারণে মাছের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে হালদা। তাই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে হালদায়। দূষণ রোধ করতে না পারলে একসময় মাছশূন্য হয়ে পড়বে হালদা। আসল কার্প জাতীয় মাছ শুধু হালদায় পাওয়া যায়। পৃথিবীর কোথাও প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন কার্প জাতীয় মাছের জিন পাওয়া যায় না। হালদার কার্প বিলুপ্ত হলে পৃথিবী থেকেও আসল কার্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বিশেষায়িত এই নদীর সম্পদ রক্ষা ও দূষণমুক্ত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। নদী দুষণকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া আমরা হালদার দূষণ রোধে ১১টি সুপারিশ করেছি। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-হালদা সংশ্লিষ্ট সব শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা, পোলট্রি ফার্মের দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, হালদাকে পরিবেশগত বিপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা, হালদা নদী কমিশন গঠন করা ও হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা।