দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে

3

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

জাতীয় কবির এ অভিব্যক্তি কষ্টিপাথরের নায় সত্য, সুন্দর ও মার্জিত। কিন্তু আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সেই সুন্দরকে কতটুকু ধারণ করছি, তা আজকের নারী ও শিশুদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড দেখলেই বুঝা যায়। নারীর নিরাপদ স্থান নিজের মা বাবা, পরিবার ও নিকটম আত্মীয় স্বজন। একান্নবর্তী পরিবারে আমরা দেখেছে পরিবারের একজন শিশু বা নারী সবসময় আদর ও স্নেহের পাত্র ছিল। তারা ছিল সকলের কাছে ছিল নিরাপদ। কিন্তু আজ সেই একান্নবর্তী পরিবার নেই, আত্মীয়তার গভীর বন্ধনও নেই। বিপরীতে সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিহিংসা, বিদ্ধেষ, লোভ ও লালসা। আমরা ঘরে বাইরে সব জায়গায় লক্ষ করছি, নারীরা প্রতিদিন বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পরিবার ও সমাজে নির্যাতনের আশঙ্কায় তটস্থ থাকছে নারী। সামাজিক এ সমস্যায় রাজনীতি জড়িয়ে পড়লে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, এর জ্বলন্ত উদাহরণ রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাত দলের হামলা ও নারী যাত্রীদের ধর্ষণ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ওই রাতে অন্তত একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সেই সঙ্গে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন বাসটিতে থাকা ছয় নারী যাত্রীর সবাই। রাজশাহীর এক নারী যাত্রীসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী ওই রাতে চলন্ত বাসে ডাকাতদলের হাতে নারী ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। ধর্ষণের ঘটনার সময় বাসটিতে ওই নারীর স্বামী ও ভাই ছিলেন। ডাকাতরা তাকে অস্ত্রের মুখে সিট থেকে তুলে টেনেহিঁচড়ে বাসের একেবারে পেছনের সিটে নিয়ে যায়। ডাকাতি চলাকালীন পুরো তিন ঘণ্টা তার ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। তবে আশ্চর্যের বিষয় তখন টাঙ্গাইলের তৎকালীন পুলিশ সুপার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন ইউনিক রোড রয়েলস বাসে ডাকাতির সময় কোনো নারী ধর্ষিত হননি। তবে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন নারী যাত্রীরা। পরে পুলিশের বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। গত রবিবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক গৃহবধূকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই নারীর হাত-পা ভেঙে সারা শরীরে ছুরি-বেøড দিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। তার ‘অপরাধ’ তিনি বিএনপি করেন, ধানের শীষে ভোট দেন। এই গৃহবধূ সুবিচারের আশায় প্রায় ৭ বছর ধরে আর্তনাদ করলেও তা তার ভাগ্যে মেলেনি। বর্বর সেই নির্যাতনের ট্রমায় এখনো মাঝরাতে আতঙ্কে তার ঘুম ভাঙে।
দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন নিপীড়নসহ পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়টি যে উদ্বেগজনক, তা বলাই বাহুল্য। আমরা দেখেছি, অতীতে সব সরকারই নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোর হাতে দমনের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধন করেছে; কিন্তু সমাজ থেকে এই ক্ষত কখনোই যায়নি। কেবল অন্তর্বর্তী বর্তমান সরকারের সময়ে শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচারকাজ দ্রুততর সময়ের মধ্যে হতে আমরা দেখেছি। আলোচিত হত্যার ঘটনার মাত্র ২ মাস ১১ দিনের মাথায় সব বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে আদালতের তরফে রায় এসেছে। দ্রুততর সময়ের মধ্যে রায় প্রদান একটি দৃষ্টান্ত অবশ্যই; কিন্তু দেশে আছিয়ার মতো শত শত শিশু ও নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সেসব ঘটনা গণমাধ্যমে কমই আসে। উল্লেখ্য, বিগত সরকারের আমলে তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলা আলোচিত হলেও এখনও বিচার কাজ শেষ হতে দেখিনি আমরা। শুধু তনু হত্যাকান্ডই কেন, নারীদের ওপর অতীতে সংঘটিত আলোচিত অনেক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনারই বিচার কাজ দূরে থাক, সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ার নজিরই বেশি।
রাজশাহীগামী গাড়িতে ধর্ষণের স্বীকার সনাতন ধর্মের কীর্তন গীতিকার, সুবর্ণচরের সেই গৃহবধূসহ এ জাতীয় বর্বর প্রতিটি ঘটনাই বিচারের আওতায় আসুক এবং দ্রুত বিচার হোক। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সংস্থাকে তৎপর হতে হবে। সমাজে নারীর অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে বলেও মনে করি আমরা। লিঙ্গ, বৈষম্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি বিভিন্ন কারণে এ দেশের নারীরা নিরাপদ নয়; এই নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে না পারলে সুশাসনের অঙ্গীকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।