দুর্যোগ সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে

2

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

সব ক্ষেত্রে নেগেটিভ ভাবনাচিন্তা শোভনীয় নয়, বরঞ্চ ভোগান্তি বাড়ায়। আবার পতিত অবস্থায়ও লড়াকু-সংগ্রামী হয়ে ওঠে। এতেকরে পারস্পরিক আর্থী ও সামাজিক সম্প্রীতিও বাড়ায়। একইসাথে নিজেদের অবস্থানও মূল্যায়ন করতে শিখায়। অবশ্য তখন একটি পদ সৃষ্টি হয়। যা কি-না সীমাহীন আত্মবিশ্বাসী করে তুলে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মাত্রার দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের এ প্রচেষ্টাও প্রশংসনীয়। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। পাশাপাশি আমজনতাও সর্বস্ব নিয়ে এগিয়ে আসে।
বলতে হয় একটি স্মরণীয় ঘটনা, ১৯৯১সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে আছড়ে পড়ে। যা ছিল বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। নিজেও সরাসরি আক্রান্ত হই। তখন চট্টগ্রামের আসকার দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ের বাসায় থাকতাম। ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে জালালাবাদ ট্রেনে করে গ্রামের বাড়ি সীতাকুÐে যাওয়া হয়।
অবশ্য পোনে নয়-টা থেকে দমকা ঝড়ো-হাওয়া শুরু হয়। রাতের ১২টার দিকে আরো তীব্রতা হয় এবং কোনো এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ঘর চাপা পড়ে। মা-ও ঘর চাপা পড়েন। অতঃপর নিজে ও মা-কে ঘরচাপা থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে যেতে চেষ্টা। এরমধ্যে দ্বিতীয় ঘরটিও আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত ওই ঘরটির উপর। এমতাবস্থায় কোথাও আশ্রয়ের জায়গা আর রইল না। অন্যদিকে বাড়ির পাশের ঘরের লোকজনও ঘরে চাপা পড়ে। তারাও বাঁচার আকুতিতে আত্মচিৎকার করতে থাকে। তাদেরও টিন কেটে অনুরূপভাবে উদ্ধার করি। এ অবস্থায়ও দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়। একবার আশ্রায়ন কেন্দ্রে আবার বাড়িতে এসে স্বজনদের খোঁজখবর নেয়া। তখনও আড়াইশ কিলোমিটার তীব্রবেগে ঝড়ো-হাওয়া বহিতে থাকে। নিজেকেও হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হচ্ছে। একেকটি বিশাল বিশাল আকৃতির গাছ নিমিষে শেকড় সহ উপড়ে পড়েছে। বাতাসে উড়ছিল বিপদজনক ঘরের টিন-ছাল। অতঃপর সকালের দিকে আস্তে আস্তে বাতাস কমে আসতে থাকে এবং একমাত্র রক্ষা পাওয়া কাছারি ঘরে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ওইদিন বিকালে বাবা শহরের বাসা থেকে গ্রামে আসেন। তিনি ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে অনেটা নিঃস্তব্ধ-নির্বাক। এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস একযোগে কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, পতেঙ্গা, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ ও হাতিয়া আঘাত হানে। অবশ্য দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থাকলেও এতোটা ভয়াবহতা আঁচ করা যায়নি। ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ¡াস আছড়ে পড়ে। যা কি-না চট্টগ্রাম জেলার সব কয়েকটি উপক‚লীয় অঞ্চল আক্রান্ত হয়। বেসরকারি হিসাবে ৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু সরকারি হিসাবে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। গবাদিপশু ২০ লাখ, গৃহহারা হন ৫০ লক্ষ মানুষ। এরমধ্যে শুধু বাঁশখালিতে মারা যায় ১২ হাজার মানুষ। হাতিয় ৮ হাজার। সব মিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি ছেড়ে যায়। অবশ্য এরপরও একজন বিধ্বস্ত পরিবারের সদস্য হয়েও চুপচাপ ঘরের কোণে বসে থাকতে পারিনি। চট্টগ্রামে কাজীর দেউড়ী-র বাংলা হোটেলে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ৩০ এপ্রিল শহরের বাসাবাড়ি থেকে ত্রাণ সামগ্রিক উত্তলন করা হয়। তার মধ্যে নগদ অর্থ, পুরোনো কাপড়চোপড়, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্যারপাইল ও নাপা ট্যাবলেট সহ চিড়ামুড়ি, গুড়, হালুয়া-রুটি সংগ্রহ করি। তৃতীয় দিন সকাল থেকে মাইক্রোবাস যোগে বিধ্বস্ত উপজেলাগুলোতে ত্রাণসামগ্রি বিতরণ করতে থাকি। সেই-এক অভিজ্ঞতা, একজন বিধ্বস্ত পরিবারের সদস্য হয়েও আত্মমানবেতর সেবায় ব্রত হই। এ ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। একই সঙ্গে ওই ২৯ এপ্রিলের ট্র্যাজেডি নিয়ে লেখা হয় একটি উপন্যাস ‘ভূমিপুত্র’।
যাক, যেকথা বলতে যাচ্ছিলাম। ২০ আগস্ট থেকে দেশের ১৬টি জেলায় বন্যা দেখা দেয়। আকস্মিক এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দিশাহারা হয়ে পড়ে। অনেকটা বলতে না বলতেই ঘরের মেঝে ও মাথা উঁচু পানি উঠে যায়। তারা প্রয়োজনীয় মালামাল সরানোর সুযোগও পাননি। মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের জোয়ার পূর্ব জোয়ার গ্রাম মেজ বোনের শ্বশুর বাড়ি। মেজবোন রওশনরা বেগম বন্যায় আক্রান্ত হন। তিনি ওই দুর্বিষহ কাহিনী বর্ণনা করেন। আড়ালের মুরগীগুলো কোনোভাবে গোয়াল ঘরের বিমের মাচাংয়ের ওপর রেখে আসে বাধ্য হয়। গরু নিয়ে রেখে আসে হয় ট্রাঙ্ক রোডের বালুর টালে। নিজেরা হাবিলদার বাসায় একটি মাদ্রাসার তিন তলায় আশ্রয়ন কেন্দ্রে দুদিন ধরে থাকতে হয়। তৃতীয় দিন তাঁর ছোট ছেলে সৌরভকে নিয়ে বড় আপনার সীতাকুন্ডের বাসায় চলে আসেন। স্বামী আব্দুল মন্নান মাস্টার ও বড় ছেলে ব্যাংকার শুভ বাড়ির চাচাদের দ্বিতল বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি রুমের চিলেকোঠায় অবস্থান নেন। চতুর্থ দিন বন্যার পানি কমে আসলে ফিরে যান শশুর বাড়িতে। তিনি বলেন, ঘরের থেকে পানি সরে গেলেও হাঁটু পরিমাণ পলি-কাদা জমে যায়। নিজেদের কাপড়চোপড় সহ সব মালামাল পঁচে গোপরে পরিণত হয়। ফ্রিজের মাছ-মাংসও পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। ওই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ৪দিন ধরে বিদ্যুৎ ছিল না। সোম, মঙ্গল ও বুধবার টানা তিনদিন ধরে ঘরদোর ও আঙ্গিনা পরিষ্কার করেও কুলে ওঠতে পারেন নি। পুকুরে পানিও কাদামাটি মিশানো-ঘোলাটে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে রান্নাবান্নাসহ ধোয়াপালা করতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন। সঙ্গে ঠান্ডাজনিত রোগ সহ পানি বাহিত রোগ দেখা দিয়েছে।
এভাবে পুরো ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজি, নোয়াখালী, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও মিরসরাই উপজেলায় বন্যা কবলিত এলাকায় এ হালহকিকত দেখা দেয়। হালদা নদীর বাঁধও ভেঙে পাশপাশের গ্রামে জলবদ্ধতা দেখা দেয়। ১ ও ২ আগষ্ট ফেনী জেলার মুহুরি, রুহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর একাধিক স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এতে নদী সংলগ্ন এলাকাগুলো প্লাবিত হয়। ২০ আগস্ট রাতে এ আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। সঙ্গে ফেনী নদীসহ সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজানের পানি প্রবেশ করে বিনা বাধায়। এলাকার লোকজন জানান, তারা ৪২ বছরে মধ্যে এমন বন্যা দেখেনি। কাপ্তাই বাঁধের জল বিপদ সীমানা পৌঁছে যাওয়ায় ৬টি স্লুইসগেট খোলে দিতে বাধ্য হয়। তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ভারতে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯ স্লুইসগেটও খোলে দেয় ভারত। এতে করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে বন্যা দেখা দেয়। ভারতের বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে বন্যা ও পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সোমবার বাঁধ খোলে দেয়া হয়। এতে করে রাজশাহী সহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। ফারাক্কা বাঁধের গেই খোলে দেয়ায় একদিনে ১১ লাখ কিউসেক পানি প্রবেশ করে। তবে পানি উন্নয়ন বোড বলছে, ভয়ের কিছু নেই, পানি বিপদ সীমানার নিচ দিয়ে যাচ্ছে এবং ঘণ্টায় ২ সেন্টিমিটার পানি বাড়ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়। বাংলাদেশ সীমান্তের থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ১৯৬২ সালে এই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ২৯ এপ্রিল। আর এটি নির্মাণ করতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে হয়ে ভারত সরকারকে। তবে প্রবল বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে বিজ্ঞানীরা- ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অসহিষ্ণুতায় বৃষ্টির বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীদের অভিমত, ১৯৭১ সালের পর প্রায় এক ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই এক ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আগের চেয়ে ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে।
মোদ্দা কথা, দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ বন্যা কবলিত হয়। এ বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাড়ানো নৈতিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতঃপর দেশের সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ দেশবাসী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাদুর্গতবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। এখন সব মিলেই দেশে অস্থিরতা অবস্থা বিরাজ করছে। একদিনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষত এখনো শুকায়নি। এর মধ্যে অস্থির পরিস্থিতে আনসারদের চাকরি জাতীয়করণের দাবি এবং তাদের বিক্ষোভ। অন্যদিকে শাহবাগ চত্বরে হেন্ডেল চালিত রিক্সা চালকদেরও অবস্থান ধর্মঘট চলে। সঙ্গে পল্লিবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধর্মঘটের হুমকি সহ রাজধানীতে অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে। এরমধ্যে ভিক্ষুকদেরও মহা সমাবেশ করার হুমকি! দেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ও নোবেল নরিয়েট ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। এসময়ে এসব দাবি-দাওয়া না জানিয়ে শান্ত থাকার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, একে একে সবার দাবি-দাওয়া শোনা হবে এবং তা পূরণ করা হবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট