দুর্ভোগে শহরের মানুষ

1

তীব্র গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আগে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা গেলেও বর্তমানে প্রায় দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ গ্যাস সংকট। অনেক আবাসিক এলাকায় সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক এলাকায় রাত ১২টার পর গ্যাস এসে চলে যায় ভোররাতেই। ফলে বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নায় সমস্যা হচ্ছে প্রতিদিন। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে রান্নার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়েছে। অনেককে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখন গ্যাস আসে তার জন্য। অনেক পরিবারকে বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের ওপর। কেউ কেউ বিকল্প উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন, ইলেক্ট্রিক চুলা, রাইস কুকার, কেরোসিন ও লাকরির চুলা। তবে ব্যবসায়ীরা অবস্থা বুঝতে পেরে সেসবের দামেও আগুন দিয়ে রেখেছে। গ্যাসের অভাবে সিএনজি স্টেশনগুলোতে দেখা যায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি। গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। সময়মতো উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিতে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। অথচ গ্যাস বিল প্রতিমাসে নিয়মিত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শীতকালে গ্যাসের লাইন সঞ্চালনে সঙ্কট দেখা দেয়ায় গ্যাসের চাপ একটু কমে যায়। সমানে ফেব্রæয়ারির শেষে ও মার্চে এ সমস্যা আর থাকবেনা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের সঙ্কট নিরসনে কিছু স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ২০২৬ সাল নাগাদ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যেতে পারে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে অনেক স্থানে গ্যাসের চাপ এবং সরবরাহ প্রায় সময়ই স্বাভাবিক থাকে না। দিনরাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকে গ্যাস সরবরাহ। অথচ গ্রাহকদের বর্ধিত হারে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হয় প্রতি মাসে। সিলিন্ডার গ্যাসের দামও চড়া- প্রায় লাগামহীন। বাড়তি উপদ্রব হিসেবে রয়েছে যখন-তখন তিতাসের পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণের নামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা। দৈনিক প্রায় ৪০০ ঘনফুট গ্যাসের বিপরীতে বর্তমানে মাত্র ২৭০ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে এসব স্থানে। ফলে গ্যাস সংকট খুব সহসাই কাটবে বলে মনে হয় না।
স¤প্রতি বেড়েছে গ্যাসের দামও। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগের দাম বাড়ানোর ফলে এর চাপ গিয়ে পড়ছে দৈনন্দিন রান্নাবান্নায়। যে বা যারা বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন, তাদের প্রতি মাসে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সিস্টেম লস কমালে গ্যাস সরবরাহে সাশ্রয়ী হওয়া যেত কিছুটা হলেও। কিন্তু গ্যাসের দুর্নীতি-অনিয়মও ওপেন সিক্রেট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস সংকট। এসব বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ও জবাবদিহির ভূমিকায় আন্তরিক হতে হবে।
শিল্প মালিকের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, গ্যাস সংকটে দেশের শিল্প খাত খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। বিপর্যন্ত এ খাত যেন যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানার মালিকরা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি পার করছেন। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট-বড় বিভিন্ন কলকারখানা। বন্ধের প্রক্রিয়ায় আরও অনেক শিল্প। যেগুলো কায়ক্লেশে চালু রয়েছে, সেগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই ক্রেতাদের অর্ডারের পণ্য সময়মতো সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। সার্বিক হতাশাজনক অবস্থায় শিল্পমালিকরা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন বিনিয়োগের আগ্রহ হারাচ্ছেন দেশিবিদেশি উদ্যোক্তারা। স¤প্রতি সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের তুলে ধরা চিত্র এমনই ভয়াবহ। গ্যাসসংকটে দেশের সিরামিক শিল্পের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পোশাক খাতে কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। ইস্পাত কারখানায় অন্তত ৩০ শতাংশ। অনেক কারখানা ফেব্রিক উৎপাদন করতে না পেরে অন্য কোনো কারখানা থেকে উৎপাদন করিয়ে নিচ্ছে। নিরূপায় উদ্যোক্তাদের অনেকে বিদেশ থেকে ফেব্রিক আনছেন। এতে ডলার ব্যয় হওয়ায় রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে নিটওয়্যার শিল্প একটা আমদানিনির্ভর রপ্তানিশিল্পে পরিণত হতে চলেছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, সংগত-অসংগত নানা ঝুটঝামেলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে শিল্পখাতকে। তার মধ্যে গ্যাসসংকট এখন বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত এর সমাধান দেশের শিল্প-বাণিজ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি নানা কারণে শতাধিক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগ বলতেই নেই বললেই অত্যুক্তি হবে না। এ অবস্থায় গ্যাস সংকট অবস্থাকে আরো নাজুক করে তুলবে। আমরা আশা করি, সরকার নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবারহে জরুরি উদ্যোগ নেবে।