নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
উনবিংশ শতাব্দিতে বাঙালির নবজাগরণের কালে রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বহু সিংহ পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিলো। আমরা এখানে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করব। রাজনীতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, দেশবন্ধু সি আর দাশ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মহাবিপ্লবী রাসবিহারী ঘোষ, বাঘা যতীন, সতীশ চন্দ্র বসু, পুলিন দাশ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কামিনী কুমার দত্ত, যাত্রা মোহন সেন, কমলাকান্ত সেন, দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্ত, শেখ-এ চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, শেখ রিয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, খান বাহাদুর সৈয়দ মকবুল হোসেন, খান বাহাদুর আবদুচ ছত্তার, মহিম চন্দ্র দাশ, নুর আহমদ চেয়ারম্যান, খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী, খান বাহাদুর আবদুল হক দোভাষ, এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী, ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী, মাস্টারদা সূর্য সেন প্রভৃতি সিংহপুরুষগণ নিখিল বঙ্গ ও চট্টগ্রামে তাদের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে চট্টগ্রামের চারজন রাজনীতিবিদ তাঁদের অসীম সাহস, অতুলনীয় প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বঙ্গীয় আইন সভায় কম্পন সৃষ্টি করেছিলেন। এই চারজন রাজনীতিবিদ হলেন-দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী এবং এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী। আমরা আজকে খান বাহাদুর, বদি আহমদ চৌধুরী ও নুরুল হক চৌধুরীর সংসদীয় বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করব। তাঁরা সিংহ বিক্রমে সংসদে তর্জন গর্জন করে আক্ষরিত অর্থে সংসদে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। আষাঢ়ের মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে আকাশ চিরে যে বৈদ্যুতি ও বজ্রপাত হয়, তেমনি খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ও নুরুল হক চৌধুরী বাংলার তৎকালীন পার্লামেন্টে প্রচন্ড হুংকার দিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন।
খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি ও বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন দু’দফায়। পঞ্চাশের মন্বন্তর বা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে (চট্টগ্রামের ভাষায় রাট) লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এই সময় চট্টগ্রামেও চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এই সময় চট্টগ্রামের জন্য চাল আদায় করতে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী আক্ষরিক অর্থেই নিজের প্রাণ ত্যাগের হুমকি দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এটা ১৯৪২ খিস্টাব্দের ৭ জুুনের ঘটনা। সেদিন খান বাহাদুর সাহেব চট্টগ্রাম বিভাগে চাল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি মুলবতী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। খান বাহাদুর উক্ত প্রস্তাবের ওপর যতবারই আলোচনা করতে চান, ততবারই স্পিকার বাধা দেন। আবার আলোচনা করতে চাইলে আবার তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন বাঁশখালীর সিংহ অমিত বিক্রমে সংসদ কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠে বলেছিলেনÑ“চট্টগ্রামে ৬০ টাকা মণ চাউল হয়েছে। বাংলার গেজেটে ঘোষণা করা হয়েছে টাকায় ১২ ছটাক চাউল, তাতেও ৫৪ টাকা মণ বোঝা যায়। উত্তর বঙ্গে ১৩/১৪ টাকা : কোন কোন জায়গায় ২০ টাকা মণ। আজ দেশের লোক না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে, আর আমার দেহে রক্ত মাংস থাকতে আমি দেশের কথা বলবো না। এই হাউসের মেম্বরদের ঢ়ৎরারষবমব কি তা ঝবপৎবঃধৎুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখন সংসদে তুমুল হট্টগোল চলছিলো।
এই হট্টগোলের মধ্যে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী বলেছিলেন : “আমি চট্টগ্রামের লোক আমার দেশের লোক অনাহারে মারা যাইবে অথচ মেম্বরী গদী রক্ষার জন্য এই (অন্যায়) আদেশ রক্ষা করিয়া (এসেম্বলী হলের) বাহির হইব, ইহা আমার পক্ষে কখন হইবে না ও হইতে পারিবেনা।
আমার ৩ কথা যথা- (১) হয়, চট্টগ্রাম বিভাগে চাউল দিতেই হইবে। অথবা (২) আমাকে এখানে মারিয়া ফেলিতে হইবে। অথবা (৩) আমি এখানে কাহাকেও কোন কাজ করিতে দিবনা।
আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত, শেষ রক্তবিন্দু শরীরে থাকা পর্যন্ত আমি বাহির হইবনা। আমার দেশের দুঃখ কষ্টের কথা আমি বলিবই বলিব।”
বাংলার পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে আছে। পরদিন ৮ জুন কলকাতার দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় এ বিষয়ে নিম্নরূপ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর বঙ্গীয় পার্লামেন্টে আত্মাহুতি দেওয়ার এ সংকল্পের মূল্য সামান্য নয়। ব্রিটিশ আমলে আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব এমন অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে যেত। যেমন ওয়ারেন হেস্টিংসর সঙ্গে বিরোধের কারণে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিলো। ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন হেস্টিংসের বন্ধু বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পে। স্পিকার যদি সংসদ মুলতবী করে বিতর্কের ওপর পানি ঢেলে না দিতেন, তাহলে বদি আহমদ চৌধুরীকে সংসদ থেকে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হতো না। বদি আহমদ চৌধুরীর ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সেটি যিনি বা যারা সম্পাদনা করেছেন, তাঁরা সংসদে বদি আহমদ চৌধুরীর প্রাণ ত্যাগের ঘোষণার তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এমনকি তাঁর সুযোগ্য সুশিক্ষত পুত্ররাও এঘটনার মর্মবস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আরো একটা গুরুতর বিষয় আছে। সেকালে একমাত্র বিপ্লবীরাই জীবন দেওয়া নেওয়ার খেলা খেলতেন। মাতৃভ‚মির শৃঙ্খল মুক্তির জন্য তাঁরা গুলি বোমা বন্দুক পিস্তল নিয়ে জীবন মৃত্যুর খেলায় মেতে উঠেছিলেন এবং কত বিপ্লবী বন্ধু যে হাসতে হাসতে ফাঁসির রজ্জু গলায় দিয়ে অট্টহাসি হেসে পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন। তো বিপ্লবীদের প্রাণ বিসর্জনের চেতনা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী কোথায় পেয়েছিলেন, সেটা গবেষণার বিষয়। বিপ্লবী যতীন দাশ ৬০ দিন কারাগারে অনশন করে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী রেলওয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়ে ফিরে আসার পথে গুলিবিদ্ধ হলে ধরা পড়ার আশংকায় সায়নাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীকে লাল সালাম।
বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে গোলযোগ ও তীব্র বাদানুবাদ
খান বাহাদুর হাজি বদি চৌধুরী ও শ্রীযুক্তা নেলী সেনগুপ্তার মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপনে স্পিকারের আপত্তি গত বুধবার বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের ধার্য্যাবস্য হইতেই তুমুল গোলমালের সৃষ্টি এবং স্পিকার ও বিরুদ্ধ পক্ষের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়। চট্টগ্রামে চাউলের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধিহেতু শ্রীযুক্তা নেলী সেনগুপ্তা যে মুলতবী প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি চাহিয়াছিলেন, তাহা স্পিকার কর্তৃক অগ্রাহ্য হওয়ায় এই গোলমালের সৃষ্টি হয়। বিরুদ্ধ পক্ষ এই বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করিবার জন্য দাবী করেন এবং অনুমতি না দেওয়ার কারণ জানিতে চাহেন। কিছুদিন পূর্বে খান বাহাদুর হাজী বদি আহমদ চৌধুরী মূলতবী প্রস্তাবের নোটিশ দিয়াছিলেন; স্পিকারের পুন:পুন: অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া তিনি বিষয়টি সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার এই আচরণের জন্য স্পিকার তাঁহাকে পরিষদ-গৃহ ত্যাগ করিতে বলেন। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী পরিষদ কক্ষ ত্যাগে অসম্মত হন। পরিশেষে স্পিকারের নির্দেশ অমান্য করার জন্য পরিষদের কার্য পরিচালনা অসম্ভব হওয়ায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পরিষদের অধিবেশন মূলতবী থাকে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন কলকাতার ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর দৃঢ়তার প্রশংসা করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটির কিয়দংশ এখানে লিপিবদ্ধ করা হল –
‘দৈনিক নবযুগ জুন, ৯, ১৯৪৪
ধন্য খানবাহাদুর!
ধন্য খানবাহাদুর হাজী বদি আহমদ চৌধুরী। তিনি যেমনভাবে নিজের নির্বাচকমন্ডলীর জন্য কর্তব্য পালনের দৃঢ়তা দেখাইয়াছেন, তাহা বাস্তবিকই তুলনাহীন। আমরা তাঁহার শোকরিয়া আদায় করার ভাষা খুঁজিয়া পাইতেছি না। তিনি যে চট্টগ্রামের লোক, সেই চট্টগ্রাম আজ সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পড়িয়া নিষ্পিষ্ট হইতেছে, স্বীয় জেলাবাসীরও বটে এবং নিজের নির্বাচকমন্ডলীরও বটে, সেই বেদনার কাহিনী তিনি আইন সভায় ব্যক্ত করিতে চাহিলেন। কিন্তু তাহাতে আসিল বাধা। সেই বাধা তিনি কোনমতেই মানিতে চাহেন নাই। দয়ালু নেতা ফজলুল হক সাহেবও খানবাহাদুর বদি আহমদ সাহেবকে তাঁহার নিজের জেলার দুঃখ দুর্দশার কাহিনী বলিতে দিবার জন্য অনুরোধ জানাইলেন; স্পিকার সৈয়দ নওশের আলী নিরুপায় হইয়া ব্যবস্থা পরিষদের লীডার স্যার নাজিমের দিকে ফ্যাল ফ্যাল নয়নে তাকাইলেন। কিন্তু স্যার নাজিম কি সেই পাত্র! তিনি সাফ জওয়াব দিলেন, “পার্লামেন্টারী নীতি ও নিয়মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলিতে দিতে তিনি রাজি হইতে পারেন না।” অমনি মন্ত্রিভজা দল হইতে ধ্বনি হইল, – “খান বাহাদুর বদি আহমদকে পুলিশ দ্বারা বাহির করিয়া দেওয়া হউক!”
কিন্ত খানবাহাদুর হাজী বদি আহমদ সাহেব তাহাতে দমিলেন না, তিনি দীপ্ত কণ্ঠে বলিলেন, – “আমার জেলার লোক না খাইয়া মরিতে বসিয়াছে, চট্টগ্রামে ৬০্্ টাকা মন দরে চাউল বিক্রয় হইতেছে, সুতরাং তাহাদের দুঃখের কাহিনী আমি বলিবই। আপনারা আমাকে হত্যা করুন, রক্তপাত করুন – যাহাই কিছু করুন না কেন, শেষরক্তবিন্দু ও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত আমার জেলাবাসীর দুঃখ-কষ্টের কথা আমি বলিয়া যাইব – কোন কিছুই মানিব না।” ইহাকেই বলে কর্তব্য পালন।
খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্রথমবার রাঙ্গুনিয়া সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের টেকনাফ পর্যন্ত ১৩ থানার লোকের বিপুল ভোটে এম, এল, সি নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত ৮ বছরকাল তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই ৮ বৎসরে এসেম্বলীর ১৮টি সেশনে ৭২০ দিনের অধিবেশন চলে।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগের ৫টি জেলা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) ও সিলেটের প্রতিনিধি হিসেবে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী বিপুল ভোটে এম, এল, এ নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন কংগ্রেস সমর্থিত এডভোকেট প্রবোধ কুমার দাস, এম-এ, বি-এল। মাত্র ১ বছর ২ মাস ছিল এই এম,এল,এ-র কার্যকাল। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ স্পিকারের বিশেষ রুলিং এ এসেম্বলি স্থগিত ঘোষিত হয় এবং ৩০ মার্চ গভর্ণর নিজে শাসন ভার হাতে নেন। তাঁর বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলীতে সদস্য থাকাকালে তাঁর এমন কোনও দিন বাকী ছিল না যে দিন না অধিবেশন চলাকালে খান বাহাদুর জনহিতকর কোন না কোনও প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। অধিবেশন চলাকালে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর বক্তৃতা থাকতো। কোনও কোনও সময় স্পিকার নিজেই বিরক্ত হতেন ও বিব্রতবোধ করতেন।
তিনি শুধু এম.এল.সি.Ñএম.এল.এ ছিলেন তাই নয় কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন কমিটির সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে কলকাতা পোর্ট হজ্ব কমিটি, ইন্ডিয়া রোড কমিটি, আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে অ্যাডভাইজারি কমিটি, বেঙ্গল এক্সসাইজ স্ট্যান্ডিং কমিটি, বেঙ্গল ইরিগেশন স্ট্যান্ডিং কমিটি, বেঙ্গল রেভিনিউ স্ট্যান্ডিং কমিটি, বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল বোর্ড, চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেনারেল হসপিটাল এন্ড মেডিক্যাল স্কুল, চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড, চট্টগ্রাম স্কুল বোর্ড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির ৬ বছর কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বদি আহমদ চৌধুরী কলকাতার বেঙ্গল লাইব্রেরি এসোসিয়েশন, বাঁশখালী এগ্রিকালচারাল ইন্ডাস্ট্রি এক্সিবিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। চট্টগ্রাম বাঁশখালীর অন্তর্গত বৈলছড়ি ইউনিয়ন বোর্ড ও বেঞ্চের তিনি ছিলেন দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে তিনি চট্টগ্রাম জমিদার এন্ড প্রজা এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার বোর্ড ও চট্টগ্রামের এন্টি-ম্যালেরিয়াল সোসাইটির সেক্রেটারি ও কলকাতার চট্টগ্রাম মোসলেম সমিতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি জেল ভিজিটর ও স্পেশাল জুরি ছিলেন দীর্ঘকাল।
খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী কতিপয় বাণিজ্যিক সংস্থার পরিচালক পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। এসবের মধ্যে কলকাতার দেশপ্রিয় সুগার মিল, পটিয়া টি কোম্পানি, হেগিং বাগান কো অপারেটিভ ট্রেডার্স ব্যাংক ও ইন্দো-বার্মা ট্রেডার্স ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কমন ইনসুরেন্স কোম্পানি লিঃ। এসবের মাধ্যমে তিনি জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ সাধন এবং তার পাশাপাশি বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থায় তৎপর ছিলেন।
জনসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার বদি আহমদ চৌধুরীকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপলক্ষে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম হলে তাঁকে এক সম্মিলিত নাগরিক সম্বর্ধনা দান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও জমিদার, জোতদার, তালুকদার সকলে উপস্থিত ছিলেন।
বদি আহমদ চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনে কৃষি আয়করের বিরুদ্ধে, শিক্ষাকর স্থগিত রাখার আন্দোলন, দেশী লবণ উৎপাদন ও বিলি বিধান ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। স্টিমার খালাসি আইন, চট্টগ্রাম-নোয়াখালী খালের টাকা মঞ্জুর, স্টাম্প ও কোর্ট ফি মূল্য, ধানের জন্য লাইসেন্স ও গ্রেফতারী, কোর্ট বিল্ডিং-এ নামাজ গৃহ, গ্রাম্য দাতব্য চিকিৎসালয়ের ওষুধব্যবস্থা, নদী-নালা-খাল বন্ধন ও খনন, বাংলা সনের হিসেবে কৃষি আয়কর, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ না হওয়ার উপায়, চট্টগ্রামে মহামারী দমন, এতিমখানা ও অনাথ আশ্রম, রাজবন্দীর মুক্তি দাবী, সাপ্লাই বিভাগের চুরি ও অপচয়, কাপড় চরকা সুতা, বেঙ্গল বার্মা স্টিম কোম্পানি রক্ষা, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সংস্কার, বিভিন্ন স্কুল কলেজে সাহায্য ইত্যাদি ব্যাপারে তিনি সর্বদা আন্দোলন সংগ্রাম ও বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন।
এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী কলকাতা ও ঢাকার ডাকসাঁইটে উকিল ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের কাট্টলীতে তাঁর জন্ম। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। প্রথম জীবনে দেশবন্ধু সি আর দাশের স্বরাজ্যপার্টি এবং পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে শের-ই বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন। তিনি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবিভক্ত বাংলার বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলসি) নির্বাচিত হন। অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নূরুল হক চৌধুরী বিশেষ করে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বিল পাস করান। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চট্টগ্রাম সমিতিরও সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর স্বরাজ্য পার্টির চীফ হুইপের দায়িত্ব পান এবং তৎকালীন রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তাছাড়াও, তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত “সুলতান” পত্রিকার বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স এর চেয়ারম্যান ছিলেন, সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির অগ্নিপুরুষ মরহুম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত মরহুম মৌলভী মুজিবুর রহমানের সাপ্তাহিক “দি মুসলমান” পত্রিকারও বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স এর ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন।
দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন এবং মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পর ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ঢাকার বিখ্যাত আইন বিশারদদের তালিকায় নূরুল হক চৌধুরীর নাম ছিলো শীর্ষস্থানে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে তিনি গণপরিষদের সদস্য (এমসিএ) নির্বাচিত হন। একই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও গণপরিষদের সদস্য (এমসিএ) ছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে নূরুল হক চৌধুরী অন্যতম। অতঃপর, তিনি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর কোয়ালিশন (যুক্তফ্রন্ট) মন্ত্রিসভার পূর্ত, শ্রম ও সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী হন। মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি করাচীতে অনেক বাঙালিকে তাঁর মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরসমূহে চাকরি প্রদান করেন। অস্থায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বলিষ্ঠ ভ‚মিকা সেসময় দেশবাসীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে তিনি একটি ঘটনায় স্পিকারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় পার্লামেন্টের মেম্বার হিসাবে নিজের অধিকার প্রয়োগে তিনি যে দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা প্রদর্শন করেন তা সংসদীয় ইতিহাসে একটি নজির হিসেবে পরিগণিত হয়। সরকার-বিরোধী দলের নেতাকে ( Opposition leader ) সম্মান প্রদর্শন করা একটি চিরাচরিত পরিষদীয় রীতি। আবার সেই নেতা যদি এমন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের লীডার হন, যে-দল ভোটা- ধিক্যে সরকার পক্ষকে (Treasury Bench) পরাজিত করতে সক্ষম তবে তাঁর প্রতিষ্ঠা আরো বেশি হয়ে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে উত্তর চট্টগ্রামের জনৈক প্রতিনিধি একটি প্রস্তাব সম্পর্কে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাইলেন। সভাপতি তাঁকে অনুমতি দিলেন না- তিনি উক্ত সভ্যকর্তৃক আনীত সংশোধনী প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করেন। বিক্ষুব্ধ সদস্যটি তখন এর প্রতিবাদ করে খলে উঠলেন : It is the arbitrary use of the power of the President.’
সম্ভবত মন্তব্যটি সম্পূর্ণরূপে সভাপতির কর্ণগোচর হয় নি। তথাপি যতটুকু তিনি শুনতে পেলেন তাতে তাঁর মনে হলো যে, তাঁর নিরপেক্ষতার প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। তখন তিনি সেই সদস্যটিকেসম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করলেন : ‘Will the Hon’ble memberPlease repeat what he said ?’ সভাপতি পুনরায় আদেশ করেন। মন্তব্যের পুনরুল্লেখ করলেন ।সদস্যটি কিন্তু নিরুত্তর রইলেন।তখন সদস্য মহোদয় তাঁর- Will the Hon’ble member please withdraw it ? – No Sir, I am not going to withdraw it.
-Then you will have to leave the Council chamber at once and you must not participate in the proceedings of the day.
-You can say whatever you like.
অতঃপর সদস্যটি পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন ।
সঙ্গেসঙ্গে পরিষদ কক্ষে বিরোধী সভ্যদের কণ্ঠে উঠল সমবেত চীৎকার ধ্বনি-‘Shame, shame.’ ডাক্তার কুমুদশঙ্কর রায়ের কণ্ঠস্বরই সভাপতি শুনতে পেয়েছিলেন । তিনি উত্তেজিত হয়ে তাঁকে বলেন :’Dr. Kumud Shankar Roy has done wrong by shouting shame, shame. Let him withdraw it at once.
Ñ I refuse to do so, Sir.
-Then I order you to leave the Council room.’নুরুল হক চৌধুরী ও ডাঃ কুমুদশঙ্কর দু’জনই ছিলেন স্বরাজ্য দলের সদস্য। দলের দু’জন সদস্যকে এইভাবে বহিষ্কৃত হতে দেখে দলপতি যতীন্দ্রমোহন তখন আর নীরব থাকতে পারলেন না । সভাপতির এই উদ্ধত আচরণ যেন পরোক্ষভাবে তাঁর দলেরই অপমান । তিনি তখন উঠে দাঁড়ালেন ও জলদগম্ভীর স্বরে বললেন :
‘‘I do protest against this sort of childish action of the President in turning out member after member for crying out shame. I think to cry out shame is a legitimate act and this is done even in the House of Commons. I do object to this sort of conduct on the part of the Chair.
– Mr. Sengupta, will you please withdraw the remark ‘childish’?
-I won’t do so.
-Then I order you to leave the Council room at once. তখন যতীন্দ্রমোহন তৎক্ষণাৎ বিনা বাক্যব্যয়ে পরিষদ কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। নাটকের যবনিকা পতন কিন্তু এখানেই ঘটল না। পরিষদ কক্ষে উঠল কলগুঞ্জন ও সৃষ্টি হলো একটি বিশৃঙ্খলার পরিবেশ। নানাজন নানা কথা বলতে থাকে। স্বরাজ্য দলের আর একজন সদস্য তখনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : ‘I say that the conduct of the President has not only been childish but worse than childish.’
সভাপতি যেন ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। এইবারও তিনি এই সদস্যটিকে বহিষ্কৃত করে দিলেন। স্বরাজ্য দলের অপর এক সদস্য তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : ‘The President’s conduct is almost insane.’ আবার সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হয়। সভাপতির এই অশিষ্ট ও অশোভন আচরণের প্রতিবাদে সকল স্বরাজী সদস্য, এমন কি স্বতন্ত্র সদস্যগণও একে একে সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন।
এখানেও কিন্তু নাটকের পরিসমাপ্তি নয়। পরের দিনই স্বরাজ্য দলের পক্ষ থেকে একযোগে পাঁচ-পাঁচটি অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সেই পাঁচটি প্রস্তাবের দাবি কিন্তু একই ছিল— সভাপতিকে বিতাড়িত করা হোক। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, মেদিনীপুরের জননায়ক বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রমুখ পাঁচজন স্বরাজী সদস্য পরপর পাঁচটি প্রস্তাব উপস্থাপিত করেছিলেন। ভোটে অবশ্য প্রস্তাব টেকেনি। না টিকলেও, সভাপতি যে তাঁর জীবনে একটি শিক্ষালাভ করেছিলেন সেদিন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক